ব্ল্যাক-আউট নামটার সাথে আমার পরিচয় যখন আমি বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশলের ছাত্র। ২০১৪ সাল। নভেম্বর মাসে হঠাৎ একদিন বিদ্যুৎ চলে যায়। বুয়েটের নিজস্ব পাওয়ার প্ল্যান্ট থাকায় তখনো বুঝতে পারিনি। বিকালে বাসায় আসার পর ধাক্কাটা টের পাই। সারা দেশে বিদ্যুৎ নাই। কি দুর্বিষহ অবস্থা! ২০০৮ সালের নির্বাচনের ইসতিহার বাস্তবায়নের নিমিত্তে সরকার তখন শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করে যাচ্ছিল। সিস্টেমের জেনারেশন ও লোড প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এর মাঝে অনাকাঙ্খিত একটি ফল্টের কারণে ২০১৪ সালের ব্ল্যাক-আউট ঘটে।

ঠিক সেই সময়ে আমি পাওয়ার মেজর নেয়ার ফলে বুয়েটের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী স্যারের সাথে থিসিসের গবেষণার কাজ শুরু করি। স্যার পিজিসিবির ডাটা নিয়ে বাংলাদেশের সিস্টেম সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করতে চাচ্ছিলেন। সৌভাগ্যবশত সেই কাজটির অংশ হতে পারি। স্যার আমাকে ডাটাগুলো দিয়ে এনালাইসিস করতে বললেন। সেই থেকে পাওয়ার সিস্টেম, স্ট্যাবিলিটি আর ব্ল্যাক-আউট সম্পর্কে আমার পড়াশোনা শুরু।

ব্ল্যাক- আউটকে এবার সহজবোধ্য আংগিক থেকে একটু ব্যাখ্যা করি। বুঝার সুবিধার্থে পুরো সিস্টেম না নিয়ে, একটি ভবন কল্পনা করা যাক। ধরে নেই ভবনটির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জেনারেটর আছে। ভবনটিতে বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার ব্যবহারকারী রয়েছেন। ভবনটিতে লাইট, ফ্যান, এসি , টিভি, ফ্রিজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের বৈদ্যুতিক যন্ত্র রয়েছে যেগুলো জেনারেটরের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে সকল যন্ত্র একসাথে অন থাকে না, কিছু কিছু যন্ত্র অন থাকে – যাকে আমরা ঐ সময়ের লোড বলি। সকল যন্ত্র একসাথে চালালে যে পরিমান বিদ্যুৎ প্রয়োজন সেটা ম্যাক্সিমাম লোড। ভবনে যে জেনারেটরটি ব্যবহৃত হবে সেটার ক্ষমতা এই ম্যাক্সিমাম লোডের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত, যেন worst case এ সব যন্ত্র একসাথে চললেও সে সাপোর্ট দিতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক যেকোনো সময়ে সব লোড একসাথে চলবে না। কেউ লাইট জালাবে, কেউ এসি চালাবে, কেউ ফ্যান অফ করবে এরকম ঘটতেই থাকবে। অর্থাৎ মানুষের ব্যবহারের পরিমান স্থির না, পরিবর্তনশীল। যখন লোড বাড়বে, জেনারেশন বাড়াতে হবে আবার লোড কমলে জেনারেশন কমাতে হবে। এই চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সবসময় ব্যালান্স রাখতে হবে। এটাকে সিস্টেমের স্ট্যাবিলিটি বলে। এখন প্রশ্ন হলো এই স্ট্যাবিলিটি কিভাবে মাপে? উত্তর হলো, আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি সেই অল্টারনেটিং কারেন্ট (AC Current) প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার উঠা নামা (দিক পরিবর্তন) করে।প্রতি সেকেন্ডে এই উঠা নামার সংখ্যাকে বলে ফ্রিকুয়েন্সি বা কম্পাংক। যতটুকু চাহিদা যদি ঠিক ততটুকু বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায় (ব্যালান্স অবস্থা) তাহলে এই ফ্রিকুয়েন্সি ৫০ হার্টজে স্থির থাকবে। যদি চাহিদার থেকে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তাহলে ফ্রিকুয়েন্সি ৫০ হার্টজের থেকে বাড়তে থাকবে। যেহেতু আমাদের দেশের যন্ত্রাংশগুলো ৫০ হার্টজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা, তাই বেশী ফ্রিকুয়েন্সিতে এগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যদি ফ্রিকুয়েন্সি অত্যধিক বেড়ে যায়, তাহলে ভবনের জেনারেটরের কিছু স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা (যেমন রিলে, সার্কিট ব্রেকার ইত্যাদি) ট্রিগার করবে এবং জেনারেটরটিকে বন্ধ করে দিবে। আবার লোডের চেয়ে জেনারেশন কম হলে ফ্রিকুয়েন্সি ৫০ হার্টজের চেয়ে কমতে থাকবে, যা আরো বেশী বিপদজনক। ফ্রিকুয়েন্সি অত্যধিক কমে গেলে এখানেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা কাজ করবে এবং সিস্টেমটিকে অফ করে দিবে। এট দুই ঘটনাই ছোট পরিসরে ব্ল্যাক-আউট।

এবার একটু বড় পরিসরে আসি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত শতভাগ বিদ্যুতায়ন বাস্তবায়নের সাথে সাথে এখন আমাদের দেশের পাওয়ার সিস্টেম বেশ বড় হয়েছে।এদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পিডিবি সহ আরো কিছু সরকারি/বেসরকারি জেনারেশন কোম্পানী (ইজিসিবি, এপিএসসিএল, নর্থ-ওয়েস্ট, সামিট, ওরিয়ন সহ আরো অনেকে)।একই সাথে ভারত থেকে কিছু বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় ।এই বিদ্যুৎ উচ্চ ভোল্টেজে সঞ্চালন করে গ্রাহকের কাছাকাছি পৌছে দেয় একমাত্র সরকারি কোম্পানী পিজিসিবি। আর পিজিসিবি থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে ভোল্টেজ কমিয়ে সরাসরি গ্রাহকের কাছে পৌছে দেয় বিতরণ সংস্থা (পিডিবি, পল্লী বিদ্যুৎ, ডিপিডিসি, ডেসকো, নেসকো, ওজোপাডিকো)। উপরে যে লোড আর জেনারেশনের ব্যালান্সের কথা বললাম সেটির সমন্বয় সাধন করে পিজিসিবির নিয়ন্ত্রনাধীন National Load Dispatch Center (এনএলডিসি)। লোড ব্যালান্স আসলে এনএলডিসির অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটা, কিন্ত জটিলতা পরিহারের জন্য বাকিগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি।

এদেশে গত একবছরে সর্বোচ্চ লোড বিগত ১৬/০৪/২২ ইং তারিখে ১৪,৭৮২ মেগাওয়াট উঠেছিল। গত একবছরে সর্বনিম্ন লোড ২০/৪/২০২২ তারিখে ৪২৬২ মেগাওয়াট। সর্বনিম্ন বললাম কেন? ধরেন দুপুর ১:০০ ঘটিকায় লোড ছিল ৫৬০০ মেগাওয়াট। দুপুর ২:০০ টায় বৃদ্ধি পেয়ে হলো ৮০০০ মেগাওয়াট,অর্থাৎ ১ ঘন্টার ব্যবধানে লোড বাড়লো ২৪০০ মেগাওয়াট। এখন পিজিসিবির এনএলডিসির প্রকৌশলীগণকে এই এক ঘন্টায় পাওয়ার জেনারেশনের সাথে কথা বলে তাদেরকে অনুরোধ করতে হবে যেন তারা উৎপাদন বাড়ায়। কিন্তু বিষয়টা এত সহজ না। যেগুলো কম্বাইন্ড সাইকেলের বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট, তাদের জিরো লোড থেক ফুল লোডে যেতে কয়েক ঘণ্টা লাগতে পারে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে এটার জন্য কয়েক মাস লাগতে পারে। ব্যাটারী ব্যাক-আপ না থাকলে নবায়নযোগ্য শক্তি ( সোলার / উইন্ড টারবাইন) তাদের জেনারেশন ইচ্ছামত পরিবর্তন করতেই পারে না। একমাত্র কাপ্তাইয়ের জলবিদ্যুৎ, হাই স্পিড ডিজেল/ গ্যাস টারবাইনের পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে বা কমাতে পারে। এরাই যুদ্ধক্ষেত্রে এনএলডিসির ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এদেরকে বলার পর লোড বাড়াতে বাড়াতেও যেটুকু সময় লাগে তার মধ্যেও যদি ব্যালান্স না করা যায় তখন এনএলডিসির শেষ অস্ত্র লোড কেটে দেয়া অর্থাৎ লোড শেডিং করা। এভাবে পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মত আমাদের দেশেও এনএলডিসি সিস্টেমকে স্টেবল রাখে। তারা সব সময় চেষ্টা করে ফ্রিকুয়েন্সী ৪৯.৫ হার্টজ থেকে ৫০.৫ হার্টজের মধ্যে রাখতে। কিন্তু কাজটা অনেক কঠিন। ধরেন সিস্টেমের লোড যদি এত দ্রুত বৃদ্ধি পায় যে,ফ্রিকুয়েন্সি নির্ধারিত হারের চেয়ে দ্রুত কমা শুরু করল অথবা লোড যদি হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস (ঝড়-বৃষ্টির কারণে একরম হয়) পেতে শুরু করে যে, ফ্রিকুয়েন্সী নির্ধারিত হারের চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে তখন সিস্টেমে রাখা স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা (প্রটেকশন) সিস্টেমকে বাচানোর স্বার্থে নিজে থেকে জেনারেশন বা লোড কেটে দেয়া শুরু করবে। এই ধাক্কাটা বড় আকারে লাগলেই, একের পর এক বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট অফ হয়ে যাবে, বিশাল এলাকায় লোড শেডিং হবে (এটাকে বলে ক্যাসকেডেড ফেইলিউর) যার নামই ব্ল্যাক-আউট বা গ্রীড ফেইল। সারা দেশের একসাথে হলে এটাকে কমপ্লিট গ্রীড ফেইল বলা যায়।

তাহলে ব্ল্যাক-আউটের কারণ হিসেবে বলা যায়, হঠাৎ বিদ্যুতের চাহিদা দ্রুত হ্রাস/ বৃদ্ধি পাওয়া, প্রয়োজন মোতাবেক জেনারেশন হ্রাস-বৃদ্ধির করতে না পারা, পাওয়ার সিস্টেমে বড় ধরণের ফল্ট/ দুর্ঘটনা হয়ে বড় কোন পাওয়ার প্ল্যান্ট বা লোডযুক্ত এলাকা মূল সিস্টেম থেকে বিযুক্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

গত ৪/১০/২২ তারিখ দুপুর ২:০৪ ঘটিকায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের ৪ টি বিভাগে (ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রাম) একযোগে ব্ল্যাক আউট হয়।

পিজিসিবি নিরাপদ সঞ্চালনের জন্য পুরো দেশকে মোটা দাগে দুই ভাগ করে সঞ্চালন করে থাকে। ট্রান্সমিশন-১ এর অধীনে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে উপরোক্ত ৪ টি বিভাগ এবং ট্রান্সমিশন-২ এর অধীনে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের বিভাগসমূহ (রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল এবং পদ্মার ওপারে ঢাকার বাকি অংশ)। অর্থাৎ যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা নদীর গতিপথ দ্বারা দেশের পাওয়ার সিস্টেম মোটা – দাগে দুইভাগে বিভক্ত। দুই অংশ আবার বড় ধরণের দুইটি সঞ্চালন লাইন ( ইস্ট – ওয়েস্ট ইন্টারকানেক্টর ১ ও ২) দিয়ে সংযুক্ত। এবারের গ্রীডের বিপর্যয়ের উৎস দেশের ইস্টার্ন জোন হলেও, এই ইন্টারকানেক্টর এর প্রটেকশন সিস্টেম কাজ করায় পশ্চিমাঞ্চলে ব্ল্যাক-আউট ছড়াতে পারেনি।

আর একবার গ্রীড ফেইল/ব্ল্যাক আউট হলে সেটাকে পুনরায় চালু করার যে প্রক্রিয়া, সেটা এতটাই সেনসিটিভ যে হিসাবে সামান্যতম গড়মিল হলে পুনরায় গ্রীড ফেইল বা মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। একারণে, এবারের ব্ল্যাক আউটে দেশের বিদ্যুৎ খাতে কর্মরতগণ যত দ্রুত সিস্টেম রিস্টোর করেছেন সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।

একবার ব্ল্যাক-আউট হলে কত ক্ষতি হয় সেটা অর্থের পরিমান দিয়ে নিরুপন করা সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ একটা দেশের অর্থনীতি ও উৎপাদনের অন্যতম চালিকাশক্তি।

ব্ল্যাক আউটের বিপর্যয়ে বাংলাদেশের প্রকৌশলী (ছবিঃ সংগৃহিত)

পাওয়ার সিস্টেম পরিচালনায় পিজিসিবি-এনএলডিসি, জেনারেশন এবং ডিস্ট্রিবিউশনের সাথে জড়িত সবার ভূমিকা আছে। মানব দেহের রক্ত সংবহন তন্ত্র যেমন দেহের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত পৌছে দেয়, তেমনি সবাই মিলে একসাথে আপনাকে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পৌছে দেয়ার জন্য কাজ করে। এখানে সবার প্রতিযোগিতা সময়ের সাথে। কোন কাজে এক সেকেন্ড দেরি করার সুযোগ নেই। আর দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার নীতিনির্ধারণ ও সার্বিক সমন্বয় সাধন করে বিদ্যুৎ বিভাগ। পুরোটা মিলে চমৎকার একটা টিম যার, মাধ্যমে দেশে শতভাগ নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতায়নের কাজ চলেছে।

পরিশেষে, বুঝার সুবিধার্থে এই লেখায় অনেক টেকনিক্যাল বিষয় বাদ দিয়েছি। পাওয়ার সিস্টেম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য ইলেকট্রিক্যাল- মেকানিক্যাল- সিএসই সহ বেশ কয়েকটি ইঞ্জিনিয়ারিং, আবহাওয়াবিদ্যা, লোডের প্যাটার্ন সম্পর্কে আগে থেকে ফোরকাস্ট করা অর্থাৎ পরিসংখ্যান ও ডাটা এনালাইসিস, দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক- ক্রীড়া- ধর্মীয় বা যেকোনো জনগুরুত্বপূর্ণ ধরণের ইভেন্ট সম্পর্কে জ্ঞান রাখা, আন্তর্জাতিক ও দেশের বিদ্যুৎ ও সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে জ্ঞান, অর্থনীতি, বানিজ্য, বিদ্যুৎ খাতের সাপ্লাই চেইন ও আরো অনেকগুলো শাখায় দক্ষ অনেক মানুষের প্রয়োজন।

লেখক
মোহাম্মদ রিফাত হক
তড়িৎ ও তাড়িতকৌশল বিভাগ (ইইই)
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
সহকারী সচিব
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ

Leave a Reply