হাজার হাজার বছর চেষ্টা করে মানুষ আর প্রকৃতি যে অন্যতম একটা প্রাণীর কাছে সবসময় পরাজিত হয়েছে সেটা হল মশা! কিন্তু এখন সেই মশাকে সমূলে ধ্বংস করার অস্ত্র আছে হাতে, প্রশ্ন হচ্ছে, সময় কি হয়েছে চালানোর? আমাদের কি পৃথিবীর সকল মশাকে মেরে ফেলা উচিত?

কেমন হবে যদি আপনার ঘর থেকে, বাসা থেকে, এলাকা থেকে এমনকি সারা পৃথিবী থেকে হঠাৎ করেই কিছু দিনের মধ্যে সকল মশা গায়েব হয়ে যায় তো? কারণ মশা কার ভাল লাগে? মশার থেকে বিরক্তিকর কীট আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দ্বিতীয় আর কি আছে? মশা জঘন্য। তারা কামড়ায়, রোগ ছড়ায়, রক্ত চোষে আরও কত কি। আপনি কি জানেন যে মশা একটা বোরিং, স্টুপিড, বিবেকবুদ্ধিহীন কীট? অবশ্যই আপনি জানেন। কিন্তু আপনি কি এটা জানেন যে পৃথিবীতে যত জীব আছে তার মধ্যে শুধুমাত্র মশার কারণে যত রোগ ছড়ায় ও প্রতিবছর যত মানুষ মারা যায়, অন্য কোন জীবের কারণে সেটা হয়না? ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা ভাইরাস ইত্যাদি মশার মাধ্যমেই ছড়ায়। মশা বর্তমানে পৃথিবীর সবথেকে প্রাণঘাতী প্রাণী। কেমন হয় যদি আমরা পৃথিবীর সব মশা ধংস করে ফেলতে পারি? আমরা অনেক কিছু দিয়ে চেষ্টা করেছি তাদের মেরে ফেলার বা দূরে রাখার, কোনটাই সফলভাবে কাজ করেনাই। কিন্তু এখন, হয়তো আমাদের কাছে সেই অস্ত্র আছে যেটা আসলেই কাজ করবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা কি সেটা ব্যবহার করব কি না, আমরা কেন সব মশাকে মেরে ফেলব না?

পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ অন্য প্রজাতি ধংস করায় পারদর্শী এক প্রজাতি। তো সেই হিসেবে মশার মত ভয়ানক এক কীটকে বিলুপ্ত করে দিতে আমাদের কোন আফসোস থাকার কথা না তাই নয় কি? উত্তরটা আসলে হ্যাঁ এবং না দুইটাই।

মানুষ এই পৃথিবীর বুকে আসারও অনেক আগে থেকে মশা বেঁচে আছে এখানে, হারিয়ে যায়নি সময়ের সাথে। হাজারো শিকারী কীট বা পরিবেশ বিপর্যয়- সবকিছুকেই পেরিয়ে এসেছে মশা। তাহলে কি হবে যদি হঠাৎ করেই মশা প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়? অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন কিছুই হবেনা, আমাদের ইকোসিস্টেমে প্রতিনিয়ত প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটছে, আর সমগ্র সিস্টেম সেভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। আবার কিছু বিজ্ঞানী ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। আসলে কি হবে আমরা জানিনা, বা সেটা নির্ণয় করাও সহজ নয়, স্পেশালি মশার ক্ষেত্রে। অবশ্য আর কারও না হলেও, কয়েল তৈরি কোম্পানি গুলোর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে, এটা বলাই যায়।

ধরে নিলাম আমরা সমগ্র মশা প্রজাতিকে ধ্বংস করে দিতে চাই। তাহলে পৃথিবীর শেষ মশা প্রজন্মের জন্ম কিভাবে হবে? গল্পটা এভাবে শুরু করা যাক- ডিম দেওয়ার ৩ দিন পরে মশার লার্ভা জন্মগ্রহণ করবে। এই লার্ভার শুরুর জীবন ব্যয় হবে বদ্ধ কোন স্থানে যেখানে তারা প্রায় ১ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকবে। যদি এটা পুংলিঙ্গ হয় তাহলে এটা বিভিন্ন উদ্ভিদ বা ফুলে ফুলে ঘুরে পরবর্তী ১ সপ্তাহের মধ্যে এর শেষ জীবনে পৌঁছে মারা যাবে, যদি এটা স্ত্রীলিঙ্গ হয় তাহলে তার কাছে প্রায় ১ মাস সময় থাকবে আশেপাশে ভার্টেব্রা প্রাণীদের রক্ত শুষে জীবিত থাকার। কিন্তু যেভাবেই হোক, মাত্র কিছু সপ্তাহের মধ্যেই শেষ প্রজন্মের মশাদের মৃত্যু হবে আর পৃথিবীর বুক থেকে সম্পূর্ণ মশা প্রজাতি বিলীন হয়ে যাবে। এরই সাথে সাথে বিলীন হবে ভার্টেব্রা প্রাণীদের মধ্যে অগণিত রোগ ছড়ানো বা তাদের মৃত্যুর কারণ আর মশাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার রহস্য।

কিভাবে? এই শেষ মশার জেনেটিক কোডের গভীরে লুকিয়ে আছে এমন এক জীন যা মশার মধ্যে একরকম বন্ধ্যা অবস্থা সৃষ্টি করে বা এর পরবর্তি প্রজন্মকে তৈরি হতে দেয়না। বংশগতির এই মরণজীন মশাদের বিলীন হবার মাত্র কিছু বছর আগেই তাদের প্রজাতির মধ্যে ইমপ্ল্যান্ট করা হবে, সমগ্র মশা প্রজাতির খুব ছোট একটা অংশ প্রথমে এই জীন বহন করবে।

শেষ প্রজন্মের প্রথম এই মশাগুলো কোন বদ্ধ ডোবা বা নোংরা স্থানে জন্মায়নি, বরং তাদেরকে উদ্ভাবন করা হয়েছে কোন এক ল্যাবরেটরিতে, তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা তাদের কোন পরীক্ষার বাক্সে বা স্লাইডের ওপর। এর প্রত্যেকটা দেখতে ঠিক তাদের প্রজাতির অন্যান্য প্রাকৃতিক সদস্যের মতই, কিন্তু এর প্রতিটা বহন করছে একটা খুব স্পেশাল জিন যা এতটাই মারাত্মক আর বিশ্বাসঘাতক যে মাত্র কয়েক ডজন জেনারেশনের মধ্যে মশাদের সম্পূর্ণ বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।

কেন হবে এসব? কারণ মশাদের হাজারো ভার্টেব্রা শিকারের মধ্যে একটা বিশেষ প্রজাতি, যা কিনা সকল মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আর উদ্ভাবনী, মশাদের এই আচরণে বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে আর নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে মশা প্রতিরোধ করার। সেই প্রজাতি হল মানুষ। এবং মানুষের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ যুক্তিযুক্ত কারণও আছে সমগ্র মশা জাতির বিনাশ করার।

রোগ ছড়ানোর মাধ্যেমে মশা বছরে সারা পৃথিবীব্যপী প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, যার মাধ্যমে মশা এখন পৃথিবীর সবথেকে ভয়ানক প্রাণঘাতী জীবের পদমর্যাদা লাভ করেছে।

মশা থেকে বাঁচতে আমরা আদিকাল থেকেই অগণিত পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছি। গ্র্যান্ড স্কেলে কেমিকেল প্রয়োগ, কীটনাশক, ধোঁয়া, মশার কয়েল, এরোসল স্প্রে আরও কত কি, যেগুলো মশার সাথে সাথে আমাদের মানবদেহের জন্যও ক্ষতিকর। মশাদের বাসস্থান ধংস করেছি, সমগ্র এলাকা পরিষ্কার করে আসছি এমনকি প্রাকৃতিক অন্যান্য প্রাণীও ব্যবহার করেছি মশা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। কিন্তু কোন কিছুই কখনও সম্পূর্ণভাবে মশাকে দূর করতে বা নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হয়নাই। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এখন হয়তো আমাদের কাছে সেই অস্ত্র আছে যা দিয়ে আমরা মশার সম্পূর্ণ প্রজাতি নির্মূল করতে সক্ষম হব।

এই প্রযুক্তির নাম ক্রিস্পার (CRISPR- Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats)। এটা একটা বিশেষ জিন এডিটিং টেকনিক যার মাধ্যমে DNA তে অতি সূক্ষ্ম ও সঠিকভাবে প্রয়োজনমত পরিবর্তন আনা যায়। এই প্রযুক্তি নিয়ে প্রথম গবেষণা শুরু হয় নব্বই এর দশকে কিন্তু বিগত কিছু বছরে এটা আরও প্রচলিত ও গবেষণার অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা DNA থেকে প্রয়োজনমত অপ্রত্যাশিত চারিত্রিক বৈশিষ্টের জিন বা অন্য ক্ষতিকর জিন সরিয়ে ফেলতে পারি, যা হয়তো কোন রোগের কারণ হয়ে ছিল এতদিন। এই প্রযুক্তির আরও একটি বড় সুবিধা হল, শুধু জিন বাদ দেওয়াই না, আমরা দরকারে স্পেশালি মোডিফাই করা জিন DNA তে ইমপ্ল্যান্ট করতে পারি যার মাধ্যমে আমরা কোন প্রজাতিতে আমাদের ইচ্ছামত পরিবর্তন আনতে পারব। অদূর ভবিষ্যতে সময়ের শুরু থেকে যেসব রোগ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে এসেছে আমরা সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারব এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র তখনই কাজ করবে যখন কোন জীন সেই রোগের মূল কারণ হয়। মশার ক্ষেত্রে যেখানে ব্যপারটা উলটা। মশা রোগ ছড়ায় কামড়ের মাধ্যমে, কোন স্পেসিফিক জিনের মাধ্যমে না। এই প্রযুক্তি তাহলে মশার ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধার না। তাহলে কেন এতক্ষন ক্রিস্পারের কথা বলা হল? কারণ রোগের কারণ যে জিন সেই জিন বাদ দেওয়ার বদলে যেই প্রজাতির কারণে সেই রোগ ছড়ায় আমরা সেই প্রজাতিকেই সম্পূর্ণরূপে বাদ দিতে পারি, যেটা হল মশা। যেই টেকনিক এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে সেটার নাম হল জিন ড্রাইভ। তাহলে দেখা যাক ক্রিস্পারের সাথে জিন ড্রাইভ কিভাবে কাজ করে।

ক্রিস্পার টেকনিক ব্যবহার করে মশার মধ্যে এমন একটা জিন ইমপ্ল্যান্ট করা হবে যা এর বেঁচে থাকার ক্ষমতাকে হ্রাস করে, এই ক্ষেত্রে যেটা এই জিন মশাদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস হ্রাস বা বিনষ্ট করে। এখন যেহেতু পুরুষ ও স্ত্রী মশা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের সাথে মাত্র ৫০% জিনোম শেয়ার করে, তাই যে কোন একটি মশার মধ্যে এই জিন ইমপ্ল্যান্ট করলে সেটা তার পরবর্তি জেনারেশনে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে ৫০%। অর্থ্যাৎ ৫০% সম্ভবনা থেকে যায় ক্রিস্পারের কাজ না করার। এখানে আসে জিন ড্রাইভ টেকনিক। জিন ড্রাইভ মশার প্রত্যেক জেনারেশনে এই জিনোম শেয়ারের হার বাড়ায়, ৫০% থেকে ৫১% হলেও সেটা অনেক এক্ষেত্রে। কারণ যদিও একটা জিনের ইফেক্টে মশা প্রজনন ক্ষমতা হারায়, জিন ড্রাইভ এই বন্ধ্যা জিন তাদের পরবর্তি জেনারেশনে বহন করে নিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা বাড়িয়ে দেয় আর এই সম্ভবনা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে আর আস্তে আস্তে সকল মশায় এই বন্ধ্যা জিন ছড়িয়ে পড়ে। অর্থ্যাৎ এই বন্ধ্যা জিনের উপস্থিতি প্রত্যেক সফল প্রজননে পরবর্তি সদস্যদের মধ্যে বাড়তেই থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না সমগ্র প্রজাতির সকল সদস্য এই জিন দ্বারা আক্রান্ত না হয়। আর যখন সেটা হয়ে যাবে তখন আর কোন মশা প্রজননক্ষম থাকবেনা। আর স্বাভাবিকভাবেই কোন প্রজাতির থেকে তার প্রজনন ক্ষমতা কেড়ে নিলে সেই প্রজাতির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়।

এই প্রযুক্তি ব্যবহার আমরা মশার ক্ষেত্রে করতে পারি। আর যেহেতু প্রতি বছর মশা প্রায় ১২ জেনারেশন পার করে, তাহলে বলা যায় এই জিন খুব দ্রুতই সমগ্র প্রজাতিতে ছড়িয়ে পড়বে। ধীরে ধীরে পৃথিবীর সকল মশা প্রজনন ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বে আর কয়েক বছরের মধ্যেই সবথেকে প্রাণঘাতী কীট সম্পূরণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

এখন কথা হল এই প্রযুক্তি এভাবে কেউ কখনো প্রয়োগ করেনি। কিন্তু তার মানে এটা না যে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন না। কনসেপচুয়াল প্রুফ হিসেবে দুইজন বিজ্ঞানীর একটি দল একটি জিন ড্রাইভ ব্যবহার করে সফলভাবে এক ধরনের ফলের মাছি প্রজাতির দেহের রঙ বদলিয়ে হলুদ করতে সক্ষম হয়েছেন।

লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ল্যাবে এই বিশেষ মশার উপর গবেষণা চালানো হচ্ছে, অন্যান্য আরও অনেক রিসার্চ ইন্সটিটিউট একই উদ্দ্যেশ্যে কাজ করে চলেছে। এটা বললেও হয়তো ভুল হবেনা যে এরকম জেনেটিকালি মোডিফাইড মশা অলরেডি কোন ল্যাবরেটরিতে বানানো হয়েছে, আমরা কি সেটা বাইরের জগতে ইচ্ছা করে বা অসাবধানতাবশত ছেড়ে দেব কি না, সেটা হল প্রশ্ন।

পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৩০০০ প্রজাতির মশা আছে যার মধ্যে মাত্র ২০০-৩০০ প্রজাতিই এমন যারা মানুষকে কামড়ায়। তাহলে এখন সমস্যা হল আমাদের আসলে সম্পূর্ণ মশা প্রজাতি ধংস করার দরকার নেই, আমরা জানি কোন কোন প্রজাতিগুলো রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। অনেক বিজ্ঞানী এইসব প্রজাতিদের নিয়ে গবেষণা করছেন যাতে করে শুধু তাদেরকে মেরে ফেলা যায় বা তাদের ভিতরের জীবাণুকে মেরে ফেলা যায় যার মাধ্যমে তারা কামড়ালেও কোন রোগ ছড়াবেনা। ক্রিস্পার ও জিন ড্রাইভ টেকনোলজি ব্যবহ্রিত হচ্ছে এসব গবেষণায়।

উদাহরণস্বরুপ বলা যায় এডিস মশার কথা। এডিস মশার একটা শ্রেণী হল এডিস ইজিপ্টাই মশা যা পীতজ্বর, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া আর জিকা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দায়ী। এডিস ইজিপ্টাই কোন সাধারণ কীট না, এটা বর্তমানে মেডিকেল সাইন্সে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কীট, কারণ বিজ্ঞানীরা এই প্রজাতি নিয়ে সবথেকে বেশী পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক রিসার্চে এটা বলা হয়েছে যে আমাদের সব মশাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার দরকার নেই, তার বদলে আমরা এগুলোকে জেনেটিকালি পরিবর্তন করতে পারি। ২০১৫ সালে অক্সিটেক নামে এক বৃটিশ কোম্পানি পুরুষ এডস ইজিপ্টাই মশা তৈরি করেন যার মধ্যে ইমপ্ল্যান্ট করা হয় একটা সেলফ-লিমিটিং জিন। এই জিন মশার কোষগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতাকে বাধা দেয়। যখন এই জেনেটিকালি পরিবর্তন করা মশাগুলো বেরিয়ে স্ত্রী মশার সাথে মিলিত হয় তখন তাদের এই অস্বাভাবিক জিন পরবর্তি প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়। এই জীনের কারণে তাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটেনা আর তার আগেই তারা মারা যায়।

একইভাবে ক্যালিফর্নিয়ার একদল বিজ্ঞানী এনোফিলিস মশার একটা প্রজাতির মধ্যে মোডিফাই করা জিন ইমপ্ল্যান্ট করেন যেই জিনের প্রভাবে মশা তার ভেতরের ম্যালেরিয়া পরজীবিকে নিজেই মেরে ফেলে, মানুষকে কামড়ানোর আগে। এইসব পরজীবি বিধ্বংসী জিন মশার পরবর্তি প্রজন্মে ৯৯% পর্যন্ত ছডিয়ে পড়ে। তার মানে আস্তে আস্তে এই সম্পূর্ণ এনোফিলিস প্রজাতি ম্যালেরিয়া পরজীবি বহন করার অযোগ্য হয়ে পড়বে আর এভাবে ম্যালেরিয়া ছড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই প্রযুক্তি মশার অন্যান্য প্রজাতির ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

আবার আরেক দল বিজ্ঞানী যেন আগুনের বিপক্ষে আগুন নিয়ে খেলছেন। মানে মশারা যেমন আমাদের মাঝে রোগ ছড়ায়, তেমনি তারা মশাদের মাঝে রোগ ছড়িয়ে দিতে চান যাতে করে তারা আর আমাদের মাঝে রোগ ছড়াতে না পারে। এক্ষেত্রে ভাইরাসের সাথে লড়তে ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া। এই পদ্ধতিতে এডিস ইজিপ্টাই মশাদের ইচ্ছে করে ওলবাকিয়া নামক ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত করা হয়। দেখা যায় ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া মশার ভেতরে রোগের অন্য ভাইরাসকে বিকাশিত হতে দেয়না। তার মানে মশা যদিও ডেঙ্গু আক্রান্ত কাউকে কামড়ায় তার পরেও মশার ভেতরে ডেঙ্গুর ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারবেনা এই ব্যাক্টেরিয়ার জন্য আর সেই মশা অন্য কাউকে কামড়ালেও ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়াবেনা। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হল ভাইরাসের বংশগত পরিবর্তন খুব দ্রুত হয় আর এভাবে কোন ভাইরাস ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, যেটা হলে সেই ভাইরাসের ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পাবে। এর সমাধান হিসেবে বিজ্ঞানীরা মশাকে সুপারইনফেক্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মানে হল একবারে মশার মধ্যে একটির বেশি ব্যাকটেরিয়া ইমপ্ল্যান্ট করা হবে যাতে করে ভেতরের ভাইরাস প্রতিরোধক না হয়ে উঠতে পারে। এভাবে আমরা মশাকে আক্রান্ত করতে থাকব আর যার মাধ্যমে মশা আর আমাদেরকে আক্রান্ত করতে পারবেনা।

ক্রিস্পার ও জিন ড্রাইভের মত উন্নত প্রযুক্তি শুধু মশাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে এমন যে কোন প্রজাতি জিন ড্রাইভ প্রযুক্তির জন্য উপযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, রক্তচোষা বাদুর এই জিন ড্রাইভের টার্গেট হতে পারে যার মাধ্যমে র‍্যাবিস রোগ ছড়ানো থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ড সরকার ঘোষণা করে যে তারা এই জিন ড্রাইভ প্রযুক্তি ব্যবহারে আরও গুরুত্ব দেবে যার মাধ্যমে যেন ৮টি বহিরাগত স্তন্যপায়ী প্রজাতির প্রাণী তাদের দ্বীপ থেকে সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়। ইঁদুর, বেজি, পসম ইত্যাদি প্রজাতির প্রাণীগুলো নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় না, বরং এরা অসাবধানতাবশত শিপিং বা মাইগ্রেশনের সময় প্রবেশ করে। বাস্তুসংস্থানে পরিবর্তন এনে এখন এরা নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় অনেক প্রজাতির প্রাণীর উপর চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এদের জন্য অনেক প্রজাতি এখন বিলীন হবার পথে। ২০৫০ সালের মধ্যে জিন ড্রাইভ টেকনিক এইসব প্রাণীদের বংশবিস্তার অনেকাংশে কমিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখবে বা এসব প্রাণীদের সম্পূর্ণরূপে দ্বীপ থেকে সরিয়ে ফেলবে।

কিন্তু মশা কোন বহিরাগত প্রজাতি না। অগণিত মৃত্যুর কারণ হলেও আমাদের ইকোসিস্টেমে মশার গুরুত্ব রয়েছে। পুরুষ মশারা ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে এবং আমরা পুরুষ মশা বাদে শুধু প্রাণঘাতী স্ত্রী মশাদের নির্মূল করতে পারব না। কিন্তু তাও মশা প্রকৃতিতে না থাকলে আসলে কি হবে বা আমাদের ইকোসিস্টেম কিভাবে পরিবর্তন হবে সেটা হিসেব করা কঠিন। হয়তো অন্য কোন প্রাণী মশার যায়গা পূরণ করবে, যা প্রকৃতিতে সৃষ্টির শুরু থেকে হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে এটাও হতে পারে যে মশার যায়গা হয়তো আরও বেশি প্রাণঘাতি কোন প্রাণী পূরণ করছে। জিন ড্রাইভ যদি স্বপ্রজাতির বাইরে গিয়ে অন্য প্রজাতিতেও পরিবাহিত হয়ে যায় তাহলে অপ্রত্যাশিতভাবে অন্য কোন প্রজাতিও বিলীন হয়ে যেতে পারে। বা কোন প্রাকৃতিক পরিব্যক্তি জিন ড্রাইভের প্রবভাবকে কমিয়ে দিতে পারে, যার মাধ্যমে মশারা এরকম জিনের প্রতি আরও বেশি প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, আমাদের সাধারণ মশা তাড়ানোর উপায়ও হয়তো তখন আর কাজ করবে না। অথবা এতকিছুর কিছুই বাস্তবে হবেনা, সুন্দরভাবেই মশাদেরকে আমরা বিলুপ্ত করে দিতে পারব। কি হবে এখনো আমরা সঠিকভাবে জানিনা, সেটা জানার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

ম্যালেরিয়া ছড়ানো মশার নাম এনোফিলিস, গ্রিক ভাষায় যার আক্ষরিক অর্থ ইউজলেস। কিন্তু আমাদের ইকোসিস্টেমে কোন সহজাত প্রজাতির গুরুত্ব, সেটা যতই মারাত্মক হোক না কেন, বা মশার মত সেটা বিলুপ্ত করে ফেলার মতই হোক না কেন, তার আসল প্রাকৃতিক অবদান নির্ণয় করা অনেক কষ্টসাধ্য। স্মল পক্স কে আমরা হারিয়েছি, সেটার জন্য আমাদের মাঝে কোন চিন্তা নেই, কেউ গিনি ওয়ার্মের (Dracunculiasis) নির্মূল হয়ে যাওয়া নিয়ে শোক প্রকাশ করছে না। তাহলে এখন প্রশ্ন হল আমাদের কি সত্যিই অপরাধবোধ অনুভব করা উচিত যদি আমরা পৃথিবীর সবথেকে মারাত্মক ও প্রাণঘাতী জীবটিকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করে দেই?

এক্সটিংশন একটা প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পৃথিবীর বুকে সময়ের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যত জীব এসেছে, তার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৯০ শতাংশের বেশি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আর বেঁচে থাকা বাকি সকল জীবই সময়ের সাথে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর সবগুলোই শুধু প্রাকৃতিক কারণে হয়নি বা হবে না। মশার ক্ষেত্রে বলতে গেলে এটা অবশ্যই প্রথমবার হবেনা যখন মানুষ কোন প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ হবে। ডোডো, প্যাসেঞ্জার কবুতর, তাসমেনিয়ান টাইগার ইত্যাদি সহ শত শত অনেক প্রজাতি পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যার কারণ আমরা, যার কারণ মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে বর্তমানে আমরা সবথেকে ভয়ানক বিলুপ্তির সময়ে বিরাজ করছি, প্রতিনিয়ত সাক্ষী হচ্ছি কোন না কোন প্রজাতির হারিয়ে যাওয়া। অত্যাধিক শিকার, নিজেদের বাস্তুসংস্থানের জন্য প্রানীর বসবাসের যায়গা নষ্ট, ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণসহ আমাদের অন্য সব অসচেতনতা বা উগ্র জীবনজাপন সব কিছুই অবদান রেখে চলেছে এই বিলুপ্তির পেছনে। হয়তো আমরা ইচ্ছা করে কেউই এরকম চাইনি বা এই বিলুপ্তিগুলো আমাদের ভুল ছিল। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রথম আমরা নিজ হয়তো নিজ উদ্যোগে কোন প্রজাতির বিলুপ্তির প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি, আর সেটা আমাদের কোন ভুল হবেনা, সেটা হবে আমাদের সিদ্ধান্ত। প্রথমবারের মত একটা প্রজাতি অন্য একটা প্রজাতির বিলুপ্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। আমরা যদি সত্যিই সবথেকে প্রাণঘাতী কীট মশার বিলুপ্তির সিদ্ধান্তে অগ্রসর হই, তাহলে হয়তো কেউই কোন অপরাধবোধের মধ্যে থাকবেনা। প্রজাতির বিলুপ্তি শুরু থেকেই হয়ে আসছে, এক প্রজাতির যায়গা অন্য কোন প্রজাতি পূরণ করছে, না করলেও ইকোসিস্টেম এমনভাবে পরিবর্তন হচ্ছে যা অবশিষ্ট প্রজাতিদের জন্য সুবিধার যায়গা করে দিচ্ছে। আশা করা যায় মশার ক্ষেত্রেও তেমনই কিছু হবে।

ক্রিস্পার ও জিনড্রাইভ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে আরও অনেক সময় আর লিখার দরকার হবে। এই প্রযুক্তি নিয়ে সব তথ্য অনলাইনে পাবেন। আলোচনা কেন্দ্রে মশাকে রাখার জন্য এই দুটি প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা শিঘ্রই হয়তো এমন প্রজাতিভিত্তক ভয়ানক মশাদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর একটি স্থায়ী সমাধান হাতে পাব। যদিও তখন মশার কামড়ে রোগ না ছড়ালেও, কামড়ে চুলকানি কিন্তু ঠিকই হবে। আপনাদের কি মতামত? আমাদের হাতে যদি সত্যিই মশা নির্মূল করার জিন ড্রাইভ থাকে তাহলে কি আমাদের মশা প্রজাতি ধংস করে দেওয়া উচিত? নাকি আমাদের অন্য কোন পথ অবলম্বন করা উচিত?

Leave a Reply