একটি মুকুটকে না ভেঙ্গে কি বলা সম্ভব, সেটি আসল স্বর্ণ দিয়ে তৈরি নাকি নকল ? আপনি যদি আর্কিমিডিসের সূত্রটি সম্পূর্ণ বুঝে থাকেন, তবে অবশ্যই সম্ভব । আমরা অনেকেই আর্কিমিডিসের সূত্রের পিছনের গল্প জানি, সূত্রটিও জানি কিন্তু এই সূত্রটি আসলে কিভাবে একটি মুকুটের স্বর্ণের ভেজাল-আসল নির্ধারন করতে পারে সেটা জানিনা । অথচ এখানে রয়েছে আর্কিমিডিসের সূত্রের আসল মজা । তাহলে আগে আর্কিমিডিসের সূত্রে আসা যাক ।

আর্কিমিডিসের সূত্রের ব্যাখ্যা

গ্রিক গণিতবিদ এবং বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস আবিষ্কার করেন যে, কোনো বস্তুকে তরল অথবা বায়বীয় পদার্থে ডুবালে বস্তুটি কিছু ওজন হারায় বলে মনে হয় । যেমন যদি একটি গাছের গুড়ি মাটিতে থাকা অবস্থায় আপনি উঠাতে না পারলেও, সেটি যখন পানিতে ডুবে থাকে তখন আপনি সেটিকে অনায়াসেই উঠাতে পারেন । অর্থাৎ আপনার কাছে এটি হালকা মনে হবে বা বস্তু ওজন হারিয়েছে বলে মনে হবে । আর্কিমিডিস এই হারানো ওজনের ব্যাখ্যা দেন । তিনি আবিষ্কার করেন পানিতে ডুবালে বস্তুর হারানো ওজন বস্তুটির দ্বারা অপসারিত তরল বা বায়বীয় পদার্থের ওজনের সমান। এটিকে আর্কিমিডিসের নীতি বা সূত্র বলা হয়।

এই সহজ ব্যাখ্যা এই যে, আপনি যদি ১০০ কেজি ওজনের এবং ৪০ লিটার আয়তনের একটি কাঠের গুটি পানিতে ডুবান তবে সেই কাঠের গুড়িটি সম্পূর্ণ পানিতে ডুবালে সেই ৪০ লিটার পানির সমান জায়গা দখল করবে বা ৪০ লিটার পানি অপসারন করবে । যেহেতু বস্তুটি ৪০ লিটার পানি অপসারন করছে, তাই বস্তুটিও পানিতে ডুবানোর ফলে ৪০ কেজি ওজন হারাবে । অর্থাৎ পানিতে ডুবানোর ফলে বস্তুটির ওজন ১০০ কেজি থেকে ৪০ কেজি কমে ৬০ কেজি হবে ।

আপনি নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পারবেন, ১০০ কেজি ওজনের এই কাঠের গুড়িটিকেও আপনি চাইলে পানিতে ভাষাতে পারবেন । আপনি যদি ঐ ১০০ কেজি ওজনের কাঠের গুড়িটি দিয়েই একটি কাঠের বাক্স তৈরি করেন তাহলে বাক্সের ভিতরে অনেকটা ফাঁকা জায়গা বাদ দেওয়ার কারণে বাক্সটির ওজন ১০০ কেজি হলেও এর আয়তন বেড়ে যাবে । ধরে নেন ভিতরে ফাঁকা জায়গা রাখায় বাক্সটির আয়তন আপনি বানালেন ১২০ লিটার । এখন এই বাক্সটি পানিতে ডুবানোর ফলে এটি ১২০ লিটার পানি অপসারন করবে ।

কিন্তু বাক্সটির ওজনই তো ছিল ১০০ কেজি, অতিরিক্ত ২০ কেজি ওজন হারানোর তো সুযোগই নেই । তাই বাক্সটিও পুরোপুরি পানিতে ডুববেনা । এই ব্যাখ্যাটি থেকেই মূলত জাহাজ বা নৌকা তৈরি করা হয় । জাহাজ বা নৌকা যে পরিমাণ পানি অপসারন করে, এদের ওজন তার চেয়ে অনেক কম থাকে ।

আর্কিমিডিস কিভাবে স্বর্ণের ভেজাল নির্ণয় করেছিলেন ?

এবার আসি আর্কিমিডিস কিভাবে স্বর্ণের ভেজাল নির্ণয় করেছিল সে বিষয়ে । প্রথমে যে মুকুটের ভেজাল যাচাই করতে হবে তিনি সেই মুকুটের ওজনের সমান পরিমাণ খাঁটি স্বর্ণ নিলেন । তাহলে এটা নিশ্চিত হল যে, মুকুটের ভর এবং তার নেওয়া স্বর্ণের ভর সমান ।

এবার তিনি সম্পূর্ণ পানি দিয়ে পূর্ণ একটি পানির পাত্রে মুকুটটিকে ডুবালেন এবং মুকুট ডুবানোর ফলে অপসারিত পানির পরিমাণ নির্ণয় করলেন । একইভাবে মুকুটের সমান ওজনের নেওয়া খাঁটি স্বর্ণটিকেও পানিতে ডুবিয়ে অপসারিত পানির পরিমাণ নির্ণয় করলেন ।

মুকুট এবং স্বর্ণ ডুবানোর ফলে অপসারিত পানির পরিমাণ যদি সমান হয়, তাহলে আমরা বলতে পারবো মুকুটের আয়তন এবং খাঁটি স্বর্ণের আয়তন সমান ।

আগেই আমরা খাঁটি স্বর্ণ এবং মুকুটের ভর সমান নিয়েছিলাম । আর এখন আয়তনও সমান হয়ে গেল ।

যেকোন বস্তুর ঘনত্ব হল বস্তুর ভর এবং আয়তনের অনুপাতের সমান । এখন দুইটি বস্তুর ভর এবং আয়তন সমান হলে অবশ্যই তাদের ঘনত্বও সমান হবে । সেভাবেই এখানে মুকুট এবং খাঁটি স্বর্ণের ভর ও আয়তন সমান হওয়ায় তাদের ঘনত্ব সমান হয়ে গেল । তার মানে মুকুট এবং খাঁটি স্বর্ণের উপাদানের ঘনত্ব সমান হয়ে গেল বা তাদের উপাদানগত মিল পাওয়া গেল । তার মানে দাঁড়াল, মুকুটটি খাঁটি স্বর্ণের তৈরি ।

আর যদি এখানে আয়তনের মিল পাওয়া না যেত, আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারতাম খাঁটি স্বর্ণের এবং মুকুটের ঘনত্ব বা উপাদান এক নয় । তার মানে মুকুটটি খাঁটি স্বর্ণের নয় । এভাবে আর্কিমিডিস মুকুটে স্বর্ণের ভেজাল নির্ণয় করেছিলেন ।

আর্কিমিডিসের সূত্র

আর্কিমিডিসের সূত্রটি হল- “কোন বস্তুকে স্থির তরল বা বায়বীয় পদার্থে নিমজ্জিত করলে বস্তুটি যে ওজন হারায়, তা ঐ বস্তু কর্তৃক অপসারিত তরল বা বায়বীয় পদার্থের ওজনের সমান”।

আর্কিমিডিসের সূত্রের প্রয়োগ

বিজ্ঞানে এই আর্কিমিডিসের সূত্রের বহুল ব্যবহার রয়েছে ।

  • এটি জাহাজ এবং সাবমেরিনের নকশায় ব্যবহৃত হয়।
  • এটি দুধের বিশুদ্ধতা নির্ধারণের জন্য ল্যাকটোমিটারে ব্যবহৃত হয়।
  • এটি তরল পদার্থের ঘনত্ব নির্ধারণ করতে হাইড্রোমিটারে ব্যবহৃত হয়।
  • মাছকে পানিতে ভাসতে সাহায্য করে।
  • কঠিন বস্তুর আয়তন নির্ণয় করা যায় ।
  • কোনো বস্তুর আপেক্ষিক গুরুত্ব বা ঘনত্ব নির্ণয় করা যায় ।
  • ধাতুর বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে প্রয়োগ করা হয়।

Leave a Reply