পর্যন্ত আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেছিল, আসলে কি এলিয়েনের অস্তিত্ব আছে ? বা এ
সম্পর্কে বিজ্ঞান সর্বশেষ কি বলছে ? আমি এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতাম । এর কারণ, আমি
যদি বলি- এলিয়েনের অস্তিত্ব আছে, তবে এরপরের প্রশ্নগুলো এরকম হবে- তারা থাকে কোথায়
? তারা আমাদের এখানে আসছেনা কেন ? তারা প্রযুক্তিতে আমাদের থেকে কতটা এগিয়ে ? আমি
চেষ্টা করব, আমার এই স্বল্প মস্তিস্কে যতটুকু জানা আছে, তার ভিত্তিতে এসব প্রশ্নের
কিছুটা উত্তর দেয়ার । তবে তার জন্য একটু ধৈর্য্য নিয়ে সম্পূর্ণটি পড়তে হবে ।

বিজ্ঞানে
মানব প্রজাতির আচরণ সবচেয়ে নির্বোধের মত বলে গণ্য করা হয় । কারণ আমরা আমাদের
নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যাপারেও সচেতন নই । অনেকেই এনট্রপি শব্দটার সাথে
পরিচিত হয়ে থাকবেন নিশ্চয়ই । আমরা জীবেরা যা কিছুই করছি, তা আমাদের চারপাশে বর্জ্র
বা বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে । যাকে এনট্রপি বলা হয় । বলা হয়ে থাকে, আমাদের বিশ্ব
প্রতিনিয়ত এনট্রপি নামক এক বয়াবহ পরিনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু আমরা এগুলোর
বাপারে এখনও সচেতন নই বা কিছুই করতে সক্ষম হই নি । আমাদেরকে নির্বোধ বলার আর একটি
কারণ, আমরা এখন পর্যন্ত নিজেদের অস্তিত্ব, আবির্ভাব এবং আবির্ভাবের কারণ সম্পর্কে
জানিনা । স্টিফেন ডব্লিউ হকিং আমাদের মত পরজীবীকে কম্পিউটারের ভাইরাসের সাথে তুলনা
করেছিলেন । তার মতে কম্পিউটারের ভাইরাস যেমন মেমোরিতে বা হার্ড ডিস্কে অবস্থান করে
নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে এবং অন্য কম্পিউটারে সেই প্রতিরূপকে পাঠাতে পারে ।
আমরা অনেকটা সেরকমই ।

সাধারণভাবে
আমরা যাকে প্রাণ বলে চিন্তা করি, তার ভিত্তি হল- কার্বন পরমাণুর শিকলের সাথে
অক্সিজেন, নাইট্রোজেন বা সালফার পরমাণুর অস্তিত্ব । তবে সেক্ষেত্রে কার্বন পরমাণুর
ধর্মগুলোর সাথে কিছু ভৌত ধ্রুবক, বৈদ্যুতিক চার্জ এবং স্থান-কালের সূক্ষ্ম
সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে । আমরা অনেকেই মনে করি, মানব জাতী সৃষ্টির জন্যই আমাদের এই
মহাবিশ্বকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে । কিন্তু অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপালের শক্তিশালী
রূপটি তো অন্য কথা বলছে । অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল অনুসারে, আমাদের এই মহাবিশ্বের
অস্তিত্ব এবং ভৌত ধ্রুবকগুলোর মান এমন হতে হবে যেন তা আমাদের মত মানব জাতীর
অস্তিত্বের অনুকুলে থাকে । অর্থাৎ এগুলো যদি ভিন্ন রকম হত, তাহলে আমি আজ এখানে বসে
এই আর্টিকেলটি লিখতাম না ।

অ্যানথ্রোপিক
প্রিন্সিপালের এই রুপটি থেকে আমরা আরও বেশকিছু বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি । তা হল-
আমাদের এই মহাবিশ্বের মত আরও অনেকগুলো মহাবিশ্ব আছে । সেগুলো প্রত্যেকটিতে ভৌত
ধ্রুবকগুলোর মান ভিন্ন ভিন্ন । তবে তার মধ্যে অল্প কিছু মহাবিশ্বের ভৌত
ধ্রুবকগুলোই কার্বন পরমাণুর এবং আমাদের থাকার অনুমোদন করে । আর এই অনুমোদিত
মহাবিশ্বের মধ্যে একটি হল- যেখানে আমরা বসবাস করছি । তার মানে প্রাণের অনুমোদন
করে, এমন অনেক মহাবিশ্ব থাকা অস্বাভাবিক নয় ।

আজ
থেকে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের
সূচনা হয়েছিল । এবং এই সূচনাকালে কোন কার্বন পরমানু ছিল না । তাহলে প্রশ্ন হল-
কার্বন পরমাণু না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব এলো কোথা থেকে ? বিগ ব্যাং বা
মহাবিস্ফোরণের পর আমাদের এই মহাবিশ্ব এতই উত্তপ্ত ছিল, সেখানে কোন পরমাণুর
অস্তিত্ব থাকাই সম্ভব ছিল না । সেই সময় সবকিছু প্রোটন, ইলেকট্রন এবং নিউট্রনরূপে
ছিল । তবে এদের সংখ্যা সমান ছিল । তবে সময়ের সাথে সাথে এই মহাবিশ্বের তাপমাত্রা
কমতেই থাকে । এর তাপমাত্রা যখন সূর্য্যের তাপমাত্রার একশত গুণ, তখন নিউট্রনগুলো
ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে ইলেকট্রন এবং প্রোটনে পরিণত হতে থাকে । এভাবে চলতেই থাকলে,
শুধু হাইড্রোজেন পরমাণুর অস্তিত্ব থাকতো । কারন হাইড্রোজেন পরমাণুতে শুধু একটি
প্রোটন এবং নিউট্রনের অস্তিত্ব রয়েছে । সে পর্যন্ত কার্বন পরমাণুর অস্তিত্ব ছিলনা
। কিন্তু পরমাণু ভাঙ্গন এবং গড়নের মত যথেষ্ট পরিমান উত্তপ্ত ছিল আমাদের এই
মহাবিশ্ব ।

মহাবিশ্ব
যখন ক্রমেই শীতল থেকে শীতলতর হচ্ছিল, তখন কিছু কিছু অঞ্চলের ঘনত্ব বেশি এবং কিছু
কিছু অঞ্চলের ঘনত্ব অনেক কম ছিল । যেহেতু নিউটনের সূত্রানুসারে মহাবিশ্বের
প্রত্যেকটি বস্তু একে অপরকে আকর্ষন করে এবং এরা যত কাছাকাছি থাকে, এই আকর্ষন বলের
মান তত বাড়তেই থাকে । কাজেই এই বেশি ঘনত্বের অঞ্চলগুলোতে পারস্পরিক আকর্ষন বল বা
মহাকর্ষ বল বাড়তেই থাকে । অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে তাদের যে প্রসারণ ঘটছিল,
একইসাথে তাপমাত্রার হ্রাস এবং মহাকর্ষ বলের বৃদ্ধির কারণে তাদের প্রসারণ থেমে
গিয়েছিল । ফলে তারা পরস্পরের উপর ভেঙ্গে পরে গ্যালাক্সি এবং নক্ষত্র তৈরি করে । যা
ঘটেছিল মহাবিস্ফোরণের প্রায় ২ বিলিয়ন বছর পর । এই নক্ষত্রগুলোর আকৃতি ছিল অনেক বড়
এবং তাপমাত্রা ছিল, সূর্যের চেয়ে অনেকগুণ বেশি । কিন্তু এক সময় তারা নিজেদের
হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম জ্বালানী ফুরিয়ে ফেলে কার্বন, অক্সিজেন এবং লোহার মত
পরমাণু গঠন করে । যা পরবর্তী প্রজন্মের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।

আমাদের
পরিচিত একটি নক্ষত্র হল- সূর্য্য । যার চারপাশে পৃথিবী সহ অনেকগুলো গ্রহ ঘুরছে ।
যাদের মধ্যে পৃথিবী জীবের বসবাসের জন্য সবচেয়ে অনুকুলে আছে । এমন অনেক নক্ষত্র
আছে, যেগুলো আমাদের থেকে অনেক দূরে অবস্থিত । যাদের চারপাশে পৃথিবীর কিংবা মঙ্গলের
মত গ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয় । আমরা সরাসরি গিয়ে সেগুলো দেখতে পারবোনা । কারণ
সেগুলোতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময়, আমাদের জীবন সীমার চেয়ে অনেক বেশি । এমনকি
আলোর বেগে গেলেও আমরা সেগুলোতে পৌঁছাতে পারবোনা । আর বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব
অনুসারে কোন কিছুর বেগ আলোর বেগের থেকে বেশি হতে পারেনা । আর যদি কোন কিছুর বেগ
আলোর বেগের তুলনায় বেশি হয়েও যায়, তবে তার ক্ষেত্রে সময় বর্তমানের থেকে ভবিষ্যতে
যাওয়ার পরিবর্তে অতিতে চলে যাবে । সেক্ষেত্রে আবার গ্রান্ড ফাদার প্যারাডক্সের মত
অনেকগুলো জটিলতা তৈরি হয় । এসব বিষয়ে আমি টাইম ট্রাভেলের পাঁচটি উপায় লেখার সময়
লিখেছিলাম । যাই হোক সেই সব নক্ষত্র সম্পর্কে জানার আমাদের দুইটি উপায় আছে । প্রথমত
সেই সব নক্ষত্রের থেকে আসা আলো পর্যবেক্ষণ । যদি সেই সব নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে কোন
গ্রহ পরিভ্রমণ করে, তবে আগত আলো কিছুটা অস্পষ্ট হবে । দ্বিতীয় উপায়টি হল- সেই
নক্ষত্রের অবস্থান পরিমাপ করা । কোন গ্রহ নক্ষত্রটির চারপাশে পরিভ্রমণ করলে সেই
গ্রহগুলো নিজেদের মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে নক্ষত্রটিকে কাঁপিয়ে দিতে পারবে ।

দ্বিতীয়
উপায়টি বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ব্যবহার করে এমন অনেকগুলো নক্ষত্র এবং তাদের
চারপাশে ঘূর্ণায়মান গ্রহ আবিস্কার করা হয়েছে । হিসেবে দেখা গিয়েছে, এসব নক্ষত্রের
প্রতি পাঁচটি গ্রহের মধ্যে এমন একটি গ্রহ আছে, যা জীবের বসবাসের জন্য অনুকূল ।

তাহলে
এই দাঁড়াল, আমাদের নিজেদের নক্ষত্রের মত এমন অনেক নক্ষত্র আছে, যার চারপাশে ঘুর্ণায়মান
গ্রহের মধ্যে কিছু গ্রহ আছে, যেখানে পৃথিবীর মতই জীব বসবাস করে পারে । অর্থাৎ
আমাদের গ্রহ ছাড়াও এমন অনেক গ্রহ আছে যেখানে জীবের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব নয় । কিন্তু
এখানে আমাদের অনেক বড় একটা বাঁধা রয়েছে । তা হল- আমরা আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবন সীমায়
এসব এসব গ্রহ সরাসরি পরিদর্শন করতে পারবোনা । এই প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করার মত
কোন প্রযুক্তি আমরা এখনও আবিস্কার করতে পারিনি । এখন শুধু একটাই উপায়, সেই সব
নক্ষত্র থেকে আসা আলো বিশ্লেষণ এবং তাদের গতিপথের গাণিতিক বিশ্লেষণ করা । অথবা যদি
সেই সব গ্রহের কেউ আমাদেরকে পরিদর্শন করতে আসে, তবে আমরা তাদের দেখতে পেতে পারি ।
এই সম্ভবনাটি বেশি । কারন আমাদের নক্ষত্র তৈরি হওয়ার অনেক আগেই তৈরি হয়েছে, এমন
গ্রহ, নক্ষত্রের সংখ্যা কম নয় । আগে তৈরি হয়েছে বিধায়, তারা তাদের প্রযুক্তির
উন্নয়নের জন্য আমাদের থেকে বেশি সময় পেয়েছে । তাই তারাই হয়তো আগে আমাদের আগে পরিদর্শন
করতে আসবে ।

জিওনআহমেদ

Leave a Reply