খুব
একটা বেশি দূর আগের কথা না । বিংশ শতাব্দী, যেটাকে আমি ব্যাক্তিগতভাবে বিজ্ঞানের
স্বর্ণযুগ মনে করি । বিশেষত ১৯০০-২০০০ সালের এই সময়কালটা । আইনস্টাইন, ম্যাক্স
প্ল্যাঙ্ক, স্টিফেন হকিং এর মত বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা ছিলেন তখন ফোকাস পয়েন্টে । এই
সময়ে যেমন বিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে, তেমনি মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে
অনেকগুলো বড় বড় প্রশ্ন । যার কিছু কিছুর উত্তর এই বিজ্ঞানীরা উৎঘাটন করতে সক্ষম
হয়েছেন, আর কিছু কিছু এখনও আমাদের মাঝে পিপাসা হয়ে রয়েছে । আপেক্ষিক তত্ত্ব,
কোয়ান্টাম তত্ত্ব, বিগ ব্যাঙ, সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব তত্ত্ব, ফটো ইলেকট্রিক
ইফেক্ট, ভয়েজার এমনকি সুপার কন্ডাক্টরের মত বিপ্লব ঘটেছে এই সময়টিতে । আমাদের এই
মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং এর এই ধারাবাহিক গতিময়তাকে নিয়ে এখনও আমাদের মধ্যে হাজারো
প্রশ্ন জমে আছে । কিন্তু এই প্রশ্নের অনেকগুলোর উত্তর আমরা এখন জানি, যা অনেকগুলো
ধারাবাহিক তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে এসেছে । এমনই এক তত্ত্ব হল, সম্প্রসারণশীল
মহাবিশ্ব তত্ত্ব । হ্যামলেট বলেছিলেন, “আমি একটি বাদামের খোসার মধ্যে আটকে যেতে
পারি, তবুও নিজেকে অসীম স্থানের সম্রাট মনে করতে পারি” । উনি কি বুঝাতে চেয়েছেন,
তা হয়তো একটু জটিল লাগছে, কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যে এর জটিলতা কেটে যাবে আশা করি ।

প্রশ্ন
হল, আমাদের এই সসীম জীবন এবং মন দিয়ে কিভাবে আমরা অসীম মহাবিশ্বকে অনুধাবন করতে
পারি ? এটা কি আমাদের জন্য ধৃঢ়তা নয় ? আমরাও কি সেই চিরায়ত পুরাণকথা অনুযায়ী
প্রমিথিউসের মত ঝুকি নেব ? যিনি মানুষের ব্যবহার জন্য প্রাচীন দেবতা জিউসের কাছ
থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন । আর যা ফলে তাকে একটি পাহাড়ে শিকল দিয়ে বেধে রাখা
হয়েছিল । যদিও হারকিউলিস তাকে মুক্ত করেছিলেন । কিন্তু আমাদেরকে কে মুক্ত করবেন ।
কিন্তু এই মহাবিশ্বকে নিয়ে টলেমীর তত্ত্ব থেকে বের হওয়ার পর গত কয়েক দশকেই আমাদের
আহরিত জ্ঞান কিছুটা বেড়েছে । তবুও আমাদের হাতে এই মহাবিশ্বের পুরো চিত্রটি নেই । যদিও
আমরা আশাবাদী সফলতা এখন আমাদের থেকে বেশি দূরে নয় ।

এখন
আমাদের মাঝে অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে । আমরা এখানে কিভাবে এলাম ? কেন এলাম ? আমাদের
শুরুটা কিভাবে ? আমাদের কি কোন শেষ আছে ? নাকি এভাবেই বিবর্তনের পর বিবর্তন ধরে
জীবের চলাফেরা চলতে থাকবে ? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগে কিংবা আমাদের নিজেদের
অস্তিত্ব নিয়ে জানার আগে আমাদের মহাবিশ্ব নিয়ে এই প্রশ্নগুলোর প্রকৃত উত্তর জানা
জরুরী । কিভাবে শুরু হল, সেকথা জিজ্ঞেস করার আগে আমাদের আগে এটা জানা দরকার- আসলেই
কি মহাবিশ্বের কোন শুরু আছে ? নাকি মহাবিশ্ব আজকাল যেমন চলছে, সেভাবেই চলতে ছিল
এবং চলতে থাকবে ? একদল বিজ্ঞানী এভাবে মনে করতেন, যেহেতু মানবজাতি জ্ঞান এবং
প্রযুক্তিতে এখনও অনেক পিছিয়ে, তাই অবশ্যই এই মহাবিশ্বের একটা শুরু রয়েছে । শুরু
না থাকলে অবশ্যই অনেক এগিয়ে যেত । আবার দার্শনিক এরিস্টটল এভাবে মনে করতেন,
মহাবিশ্ব এভাবেই চিরকাল টিকে আছে এবং থাকবে । কোন কিছুর সূচনা আছে এমনটা বলার চেয়ে
কোন কিছুর চিরকাল এমন আছে এবং থাকবে বলাটা অনেকটা সহজ । এরিস্টটল এমনটাই মনে
করতেন, মহাবিশ্বের কোন শুরু বা শেষ নেই । একইভাবে সময়ের কোন শুরু নেই । সময় অবিরত
গতিতে চিরকাল অতিত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের দিকে চলমান থাকবে । অর্থাৎ এটি
যেমনটি আছে, তেমনটিই থাকবে । আর আমাদের প্রযুক্তিতে পিছিয়ে যাওয়ার কারন, বারেবারে
প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে আমরা পিছিয়ে গিয়েছি বলে তিনি উল্লেখ করেন ।

আবার
সূচনা আছে এমনটা ভাবলে সেখানে স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন রয়েছে । কিন্তু চিরকাল
এমনটা আছে এমনটা বললে, স্বর্গীয় চিন্তার জটিলতায় পড়তে হয়না । কিন্তু এটা তো কোন
কারন হতে পারেনা । মহাবিশ্বের কোন সূচনা থাকলে সেটা অবশ্যই থাকবে । সেটা সকল ধারনা
এবং জটিলতার উর্ধে । এমনটাই বলেছিলেন স্টিফেন ডব্লিউ হকিং । এমনকি মহাবিশ্বের যে
একটা সূচনা রয়েছে, সেটা তিনি নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছিলেন । অবশ্য তার এমনটা মনে
করার অনেকগুলো যৌক্তিক কারনও ছিল । হাবল টেলিস্কোপের মাধ্যমে বিজ্ঞানী এডুইন হাবল
এটা প্রমান করেছিলেন যে, দূরের নক্ষত্র থেকে আমাদের পৃথিবীতে আসা আলোর তীব্রতা
ক্রমস কমতেই আছে । তার মানে সেগুলো আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে । অবশ্য এর
বিপক্ষেও এর বিরোধিতাকারীদেরও অনেক শক্তিশালী অনেক যুক্তি ছিল । তারা উল্লেখ
করলেন, সময়ের সাথে নক্ষত্র সমূহের আলোর তীব্রতা কমতেই আছে, তাই আমরা এমনটা দেখছি ।
কিন্তু এডুইন হাবলের যুক্তিগুলো অধিক যুক্তিযুক্ত ছিল বলে এটি গ্রহণযোগ্য হয় যে,
অবশ্যই এই মহাবিশ্বের সকল বস্তু একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে । এবং যে বস্তু বা
নক্ষত্র আমাদের থেকে যত দূরে, সেই বস্তু বা নক্ষত্র আমাদের থেকে তত বেশি বেগে দূরে
সরে যাচ্ছে । তার মানে আমরা নক্ষত্রগুলোকে বর্তমানে যতটা কাছাকাছি দেখছি, এগুলো
আমাদের অতিতে এর অধিক কাছাকাছি ছিল । এভাবে হিসাব করে দেখা যায়, প্রায় ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন
বছর আগে সমস্ত ছায়াপথ একটি বিন্দুতে ছিল । যার ঘনত্ব ছিল অসীম । যাকে আমরা পরম
বিন্দু বা স্থান কালের সিঙ্গুলারিটি বলে থাকি । আর এটাই ছিল মহাবিশ্বের সূচনা ।

কিন্তু
এ পর্যন্ত মেনে নিলে অনেকগুলো নতুন প্রশ্নের উদয় ঘটে । আসলেই যদি মহাবিশ্বের কোন
পরম বিন্দু বা স্থান-কালের সিঙ্গুলারিটি থেকে থাকে, তবে এই সিঙ্গুলারিটির মধ্যে
ভাঙ্গন ঘটল কি করে ? যা ঈশ্বরের ধারনাকে ইঙ্গিত করে । কিন্তু বিজ্ঞানীরা এমনটা মেনে
নিতে নারাজ । কারণ অনুসন্ধানের চেয়ে ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দেয়া সহজ হলেও তারা যদি এটা
ঈশ্বরের হাতেই ছেড়ে দেয়ার মত হত, তবে এটা তারা আগেই দিয়ে দিত । তারা এতদূর পর্যন্ত
পারি দিত না । এসলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির মূহুর্তের এই পরম বিন্দু বা স্থান-কালের
সিঙ্গুলার বিন্দুর উপর স্রষ্টার হস্তক্ষেপের প্রশ্ন এজন্য আসে, কারণ এই পরম
বিন্দুতে আইনস্টাইনের সাধারন আপেক্ষিক তত্ত্ব অকার্যকর হয়ে যায় । এমনকি
হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতিও এখানে অকার্যকর হয়ে যায় । যেখানে তিনি বলেছিলেন,
একই সাথে বস্তুর অবস্থান এবং ভরবেগ নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয় । কিন্তু এই
পরম বিন্দুতে বস্তুর অবস্থান এবং ভরবেগ উভয়ের মান শুন্য । যা দুইটি নিখুঁত মান ।
তাহলে আমরা এই জটিলতাকে কিভাবে কাটিয়ে উঠবো ? সেটা নিয়ে অন্য একদিন লিখবো ।

জিওন
আহমেদ

Leave a Reply