বিগত কয়েকদিনের মত আজকেও রংপুর শহরে ঘুরাঘুরি করতেছিলাম । হাতে কোন কাজ নেই তাই । একটা উক্তি শুনেছিলাম, নেই কাজ তো খই ভাজ । আমার কাছে এই মুহুর্তে খই ভাজার বিশেষত্ব হল- ঘুরাঘুরি করা । আমার অতিত বলতে কিছু নেই । যা আছে সবই বর্তমান ।

হাঁটতে হাঁটতে পথে হঠাত আমার দুই বন্ধুর সাথে দেখা । ওদের নাম মিলু এবং তুলি । ওদের সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি দিন না হলেও, ওদের বিশেষত্ব আমার কাছে অনেক বেশি । কিন্তু আজ ওদের একটু বেশিই চিন্তিত মনে হচ্ছে । বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার মত নয় । কারণ এদেরকে আমি এই প্রথম চিন্তিত আবিস্কার করলাম । কাছে গিয়ে অনেকবার জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু এরা কিছু বলছেনা । আজ তো আমার জন্মদিন নয়, যে এরা আমাকে কনফিউজড করবে । পাশের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম আমরা তিনজন । এখানে আসার পর তুলির মুখে বুলি ফুটলো । আমার বন্ধু মিলুর একটা মারাত্মক ডিজওর্ডার আছে । কিন্তু আমি এটাকে ঠিক ডিজওর্ডার বলবোনা । এটা ওর একটা বিশেষত্ব । সেটা হল- ও ওর স্বপ্নে নিজের ভবিষ্যতের এক একটা বিশেষ অংশ করে দেখতে পায় । এটাকে ওর বিশেষত্ব বললাম এ কারণে, ও স্বপ্নে যা দেখে ঠিক তাই ওর ভবিষ্যৎ । এতে কোন অনিশ্চয়তা নেই । হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি আমাদের মিলুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় ।

এবার তুলি আমাকে যেটা বলল, সেটার জন্য আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না । মিলু গত রাতে স্বপ্নে দেখেছে, আসছে ২০২৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঠিক এই সময়ে মিলু তুলিকে গুলি করে মেরে ফেলবে । মেরে ফেলার কারণ হিসেবে যা জানলাম, সেটাও অনেকটা অবাক হওয়ার মত । সেটা ছিল- ২০১৫ সালে ওদের প্রথম পরিচয়ের ঘটনা । সেই সময়ে মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুকে কোন এক পোস্টে মিলু আর তুলির মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া হয় । সেই ঝগড়া হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা একে অপরকে চিনতো না । ঝগড়ার এক পর্যায়ে, তুলি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মিলুকে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে ফেলে । যা মিলুর কাছে হজমের উপযুক্ত ছিলনা । সেদিন ঝগড়ার পর ওদের একটা ভাল বন্ধুত্ব হয় । তুলি মিলুকে বন্ধুই ভেবেছিল, কিন্তু মিলুর বন্ধুত্ব করার কারণটা ভয়াবহ ছিল । তুলিকে গালির জন্য শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যেই মিলু ওর সাথে বন্ধুত্বটা গড়ে তুলেছিল ।

আজ ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর । ওদের বন্ধুত্বের ৫ বছর পূর্ণ হল । রাগ এবং প্রতিশোধের ইচ্ছা নিয়ে বন্ধুত্ব করলেও, মিলুর মনে তুলির প্রতি এখন আর কোন রাগ নেই । এখন ওরা মন থেকেই অনেক ভাল বন্ধু । আর সেটা আমিও জানি ।

কিন্তু গত রাতে মিলু স্বপ্নে দেখেছে, আগামী ২০২৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর কোন এক কারণে মিলুর তাদের প্রথম পরিচয়ের সেই গালির কথা মনে পড়ে যায় । যার কারণে মিলু তুলিকে গুলি করে মেরে ফেলে । এটা যদি নিছক স্বপ্ন হত, তাহলে হয়তো সমস্যা হত না । কিন্তু আগেই বলেছি, মিলু যা স্বপ্নে দেখে তাই ওর ভবিষ্যৎ ।

কিন্তু মিলু নিজের এই ভবিষ্যৎ বদলাতে চায় । সে চায় না, তার এত ভাল বন্ধুর সাথে সে ভবিষ্যতে এই নির্মম কাজটি করুক । তুলিও নিজেকে অপরাধী ভাবছে । সে গালিটা না দিলেই পারতো । যদি অতিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হত, তাহলে সে এই কাজটি থেকে বিরত থাকতো । অতিতে যা হবার সেটা যদি কিছুটা মেনেও নেয়া যায়, ভবিষ্যতে যা হতে চলেছে, তা থামাতে হবে । কিন্তু কিভাবে ?

আমার কাছে এর একটি উপায় ছিল । তাই ওদেরকে আর বেশি ভাবার সময় দিলাম না । কাজটা যে একটু কঠিন এবং রিস্ক আছে, সেটা ওদের জানিয়ে দিলাম । ওরা রাজি হয়ে গেল । আমি এবার ওদেরকে সম্পূর্ণ আশ্বস্ত করে উপায়টি শিখিয়ে দিয়ে সে অনুসারে কাজ শুরু করলাম । আর একাজে ওদের অস্ত্র হল, আমার দুইটা টাইম মেশিন । যার একটা দিয়ে অতিতে চলে যাওয়া যায়, আর একটা দিয়ে ভবিষ্যতে । যেহেতু আজ থেকে ঠিক ৫ বছর আগে এবং ৫ বছর পরে ঘটেছিল, তাই টাইম মেশিন দুটোকে একই গতিতে করে দিলাম । যাতে যখন মিলু টাইম ট্রাভেল করে ভবিষ্যতে গিয়ে ঠিক তুলিকে গুলি করার মূহুর্তে গিয়ে পৌছাবে, ঠিক সেই সময় তুলি সেই গালি দেয়ার মূহুর্তে গিয়ে পৌঁছায় ।

এবার তুলি এবং মিলুকে কি করতে হবে, সেটা বলে দিলাম । তুলি অতিতে গিয়ে সেই কমেন্ট করার সময় মিলুকে যে গালি দিয়েছিল, সেটা থেকে বিরত থাকবে । আর মিলু যেহেতু এখন জেনেই গেল, তুলি অতিতে গিয়ে গালি দেয়া থেকে বিরত থাকছে, মিলু ভবিষ্যতে গিয়ে বন্দুক হাতের নিজেকে গিয়ে এটা জানিয়ে দেবে- তুলি তাকে আসলেই গালি দেয়নি । ফলে ভবিষ্যতের মিলু সেটা ভাবতে শুরু করবে । যেহেতু তার ভাবার মূহুর্তেই অতিতের তুলি তার গালিটা তুলে নিয়েছে, তাই ভবিষ্যতের এই মিলু যখন ভাবা শুরু করবে- অতিতের গালিটা তুলি তুলে নেয়ায় তার জীবনের সেই দাগটি মুছে যাবে । ফলে ভবিষ্যতের সেই মিলু তুলিকে গুলি করা থেকে বিরত থাকবে ।

তুলি আর মিলু আমার পুরো প্ল্যানটি বুঝে ফেলল । এবার তুলিকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং মাস্ক সহ আর মিলুকে মুখে গেলমেট পরিয়ে টাইম ট্রাভেল মেশিনে দিতে গেলাম । যাবার পথে তুলি আমাকে জিজ্ঞেস করল, তাকে কেন অক্সিজেন নিয়ে যেতে হচ্ছে ? তুলিকে জানিয়ে দিলাম, অতিতে সে পরিবেশের অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে জীবন অতিবাহিত করেছিল । তাই সে এখন অতিতে ফিরে যাওয়ার সময় পূনরায় অক্সিজেন পরিবেশ থেকে পবেনা । কারণ আগেই সে তার ভাগের অক্সিজেন খেয়ে নিয়েছে । এখন হয়ত সে তার রেখে আসা কার্বন ডাই অক্সাইড পেতে পারে । যার বিনিময়ে তাকে আবার অক্সিজেন ত্যাগ করতে হবে । যেহেতু তাতে তুলির মৃত্যু নিশ্চিত, তাই তুলির জন্য এই ব্যবস্থা । দুজনকেই হেলমেট পড়িয়ে দিলাম, যাতে কেউ তার ভবিষ্যতের নিজের সাথে মুখোখি না হয় । তাহলে ওরা একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে বা মেরে ফেলতে পারে ।

এবার ওদেরকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি বসে বসে ঘুমাতে শুরু করতে উদ্যত হলাম । কিন্তু তার আর সুযোগ হল না । ওদেরকে পাঠানোর কয়েক সেকেন্ড পরেই ওরা ফিরে এলো । ততক্ষণে রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যে রিকশাটি যাচ্ছিল, সেটা মাত্র এক মিটারের মত সামনে এগিয়ে গেছে । ওরা যখন যাত্রা শুরু করেছিল, তখন আমাদের কফিটা টেবিলের উপরেই ছিল । সেটা থেকে এখনও ধোয়া উড়ছে । সবকিছু আগের মতই দেখে তুলি আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি ওদের যাত্রা করার মূহুর্তের মত সবকিছু কিভাবে আগের মতই রেখে দিলাম । আমি হাসি থামাতে পারিনি । ওরা যে একটু আগেই টাইম ট্রাভেল করে পুনরায় বর্তমানে ফিরে এলো, যা আমার কাছে এক সেকেন্ডেরও কম সময়, সেটা ও বুঝতেই পারল না ।

ওদের দুজনই আমাকে একটা জটিল প্রশ্ন করে বসল । আমি যদি শুধু তুলিকে তার অতিতে পাঠিয়ে দিয়ে, অতিতের কাজটি শুধরানোর সুযোগ করে দিতাম অথবা শুধু মিলুকে ভবিষ্যতে পাঠিয়ে তার ভবিষ্যতের কাজটি থেকে তাকে বিরত করতাম, তাহলেই তো হত । কিন্তু আমি কেন দুজনকেই  ব্যবহার করলাম ।

এটা আমার কিছুটা ব্যাক্তিগত প্রশ্ন । আমি আসলে টাইম ট্রাভেলের এই পুরো অভিজ্ঞতাটুকুতে প্যারাডক্স বিষয়টিকে বিশ্বাস করিনা । আমি যদি শুধু তুলিকে পাঠাতাম, তবে মিলু যে তার তার কাজ থেকে বিরত থাকবে সেটা নিশ্চিত নয় । বরং মিলু প্যারাডক্স জটিলতায় পরে যেত । কাজেই মিলুর ভবিষ্যতে তুলিকে গুলি করা থেকে বিরত থাকা আমার কাছে অন্তত অনিশ্চিত ছিল । তাই আমি কোন রিস্ক না নিয়ে তাদের দুজনের জীবনের এই পার্ট টুকু মুছে দেই ।

Leave a Reply