সময়টা ছিল
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের । গোটা ইউরোপ মত্ত ছিল এই যুদ্ধে । ইউরোপকে গ্রাস করতে
লন্ডনে বোমা ফেলছেন জার্মানি হিটলার । ঠিক সেই সময় ফ্রাঙ্ক হকিং নামক এক যুবকের সাথে
ইসোবেল হকিং নামক এক তরুণীর বিয়ে হয় । বিয়ের পরপরই এই চিকিৎসক দম্পতির কোলে জন্ম
নেয় এক শিশু, যার নাম রাখা হয়েছিল স্টিফেন উইলিয়াম হকিং । যুদ্ধের এই অবস্থায়
সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তারা পাড়ি জমান অক্সফোর্ডে ।

ধীরে ধীরে
বড় হতে লাগলেন স্টিফেন উইলিয়াম হকিং । সেই সাথে স্কুল-কলেজ ও পেরোতে থাকেন ।
মোটামুটি ভাল মার্কস পেয়ে সব ক্লাস উতরে গেলেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোন সাফল্য তিনি তখনও
কুড়াতে পারেন নি । তবে বিজ্ঞানের প্রতি ছিল তা নিখাদ ভালবাসা । বিজ্ঞানের প্রতি
চিন্তা, চেতনা এবং উৎসাহ দেখে বন্ধুরা মাঝে মধ্যেই তাকে আইনস্টাইন বলে ডাকতেন । তবে
বাবা ফ্রাঙ্ক হকিং ইচ্ছা ছিল ছেলে ডাক্তার হবে ।

এরপর
গনিতে পড়ার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে স্টিফেন হকিং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হন । কিন্তু
গনিত তার ভাগ্যে হল না । তাই তিনি বাধ্য হয়ে পদার্থবিজ্ঞানকেই বেছে নেন । ১৯৫৯
সালে অক্সফোর্ডে তার পড়ালেখা শুরু হয় । যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর । কিন্তু অক্সফোর্ডের
শেষের দিকে ১৯৬২ সালের দিকে নিজের মধ্যে শারীরিক অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন হকিং ।
দেখা যাচ্ছিল, তিনি মাঝে মধ্যেই সিরি বেঁয়ে ওঠা-নামা করার সময় পড়ে যাচ্ছেন । মুখের
কথাও আগের মত স্বাভাবিকভাবে বলতে পারছেন না ।

সাল
১৯৬৩ । ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে অক্সফোর্ডে ছুটি পেলে সেবার বাড়ি যান স্টিফেন হকিং । ছেলের
এই অস্বাভাবিকতা বাবা-মার চোখে পড়ে । তারা চিন্তায় পড়ে যান । তাকে হাসপাতালে নেয়া
হলে ডাক্তার যা তাদেরকে শুনিয়েছিলেন, তার জন্য তাদের কেউই মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না
। স্টিফেন হকিংকে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানালেন, হকিং মোটর নিউরন নামক দুরারোগ্য
ব্যাধিতে আক্রান্ত আক্রান্ত হয়েছেন । যার নাম অ্যামিওট্রোফিক ল্যাটারাল
স্কেলেরোসিস (এএলএস) । পূর্ব ইতিহাস অনুসারে এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা ২ বছর পর্যন্ত
বেঁচে থাকতে পারেন । তবে অস্বাভাবিকভাবে মাত্র দুই থেকে তিন ভাগ ব্যাক্তি সর্বোচ্চ
৩ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড ছিল । এর চেয়ে বেশিদিন বেঁচে থাকার কোন রেকর্ড
এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের ছিলনা ।

ডাক্তারদের
এমন কথা শুনে হতাশ বাবা মা তাদের ২১ বছর বয়সী ছেলের মৃত্যুর প্রহর গুণতে লাগলেন ।
নিজের সবটুকু দিয়েও যখন ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন না, তখন তারা মানসিকভাবে হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন
। কেবল হাল ছাড়লেন না স্টিফেন হকিং । চিকিৎসকদের কথায় কান না দিয়ে নিজের
মানসিকতাকে বাঁচিয়ে রাখতে শুরু করলেন স্টিফেন হকিং । নিজের শরীরের নিশ্চিত সমাধিকে
নিজের চিন্তা থেকে বাইরে সরিয়ে নতুন উদ্যোমে অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে লাগলেন । এরপর
অক্সফোর্ড থেকে কৃতিত্বের সাথে অনার্স ডিগ্রি পান স্টিফেন হকিং । পড়ে পিএইচডি করতে
পাড়ি জমান কেমব্রিজে । সেখানে জেন ওয়ার্ল্ড নামক এক নারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয় । তিনি
১৯৬৫ সালে জেন ওয়ার্ল্ডকে বিয়ে করেন ।

ধীরে ধীরে
তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকল । তার দৈহিক সক্ষমতা আরও কমতে থাকল । এক সময় তাকে
ক্রাচের উপর নির্ভর করে হাঁটা-চলা করতে শুরু করতে হল । তার মুখের কথা আরও জড়িয়ে
যেতে শুরু করল । পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ তার কথা বুঝতে পারত না । একটা
সময় হাতে লেখার ক্ষমতাটুকুও লোপ পেল । আর নিজেকেও হুইল চেয়ারে অবদ্ধ করতে হল ।

এত কিছুর
পরেও থেমে গেলনা তার মস্তিস্ক । সবকিছুর মধ্যেও তিনি নিজের মগজকে সচল রেখেছিলেন ।
হুইল চেয়ারে বসেই বিজ্ঞানের চিন্তায় নিজেকে মগ্ন করে রাখতেন । এতে নিজের অধ্যায়ন আরও
বাড়িয়ে দেন । পদার্থবিদ ওয়ার্নার ইসরায়েল স্টিফেন হকিং এর এই আপ্রাণ চেষ্টাকে
মোজার্টের সাথে তুলনা করেন । কারণ, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মোজাক পুরো একটা সিম্ফোনি তার
মাথার মধ্যে কম্পোজ করতেন ।

কঠোর পরিশ্রম
আর অপ্রতিরোধ্য মানসিক শক্তি নিয়ে ১৯৬৬ সালে স্টিফেন হকিং মহাবিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ব
নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন । একইসাথে রজার পেনরোজের সঙ্গে যৌথভাবে মহাকর্ষীয়
পরম বিন্দু নিয়ে গবেষণা করেন । পরবর্তিতে যার একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয় । যার শিরোনাম
ছিল, “পরম বিন্দু ও স্থান-কালের জ্যামিতি” । একই বছর মর্যাদাপূর্ণ অ্যাডামস
পুরস্কার পান স্টিফেন হকিং । এরপর ১৯৭৪ সালে কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী
করেন যা হকিং বিকিরণ নামে পরিচিত । গানিতিকভাবে স্টিফেন হকিং দেখান- আমরা আসলে
যতটা কালো বলি, কৃষ্ণগহ্বর আসলে ততটা কালো নয় । এর মধ্য থেকে সামান্য পরিমাণ আলো
বিকিরণ হিসেবে বেড়িয়ে আসে । যা বেশ কয়েক বছর আগে পদার্থবিদগণ আবিষ্কার করেন । এরপর
১৯৭৯ সালে কেমব্রিজে লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন স্টিফেন উইলিয়াম হকিং ।
যে পদে এক সময় নিযুক্ত ছিলেন বিজ্ঞানী নিউটন । এই কেমব্রিজেই স্টিফেন হকিং তিনি
জীবনের পরবর্তী ৩০ বছর শিক্ষকতা করেছেন ।

১৯৮৫
সালে স্ত্রী জেনকে নিয়ে ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ডের সীমান্তে ইউরোপের পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রে
যান স্টিফেন । সেখানে আবারও তার জীবনে বিপত্তি নেমে আসে । সেখানে স্টিফেন হকিং
মারাত্মকভাবে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন । আবারও মৃত্যুর মুখোমুখি হন স্টিফেন হকিং । তাকে
লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় । এক সময় অবস্থার চরম অবনতি ঘটলে ডাক্তাররা সব আশা ত্যাগ
করে তার থেকে লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত জানান । কিন্তু স্ত্রী জেনের অনুরোধে
তার থেকে লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নেয়া হয়নি । তবে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা
করতে গিয়ে তার গলায় ছিদ্র করে ট্র্যাকোটোমি করতে বাধ্য হয় । ফলে চিরকালের মত বাকরূদ্ধ
হয়ে পড়েন স্টিফেন হকিং । তবে মৃত্যুর সঙ্গে বেশ কিছুদিন লড়ে সুস্থ হন স্টিফেন হকিং
। তখন অন্যদের সাথে তার যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চোখের ভুরুজোড়া । চোখের ভুরু নাড়িয়ে
কাগজে লেখা শব্দের দিকে ইঙ্গিত করে যোগাযোগ রক্ষা করতেন তিনি ।

কিন্তু
ভাগ্য এবার তাকে কিছুটা ধরা দিল । ১৯৮৬ সালে ইকুয়েলাইজার নামক এক কম্পিউটার প্রোগ্রাম
পেয়ে যান স্টিফেন হকিং । এই প্রোগ্রামটি বানিয়েছিলেন ওয়ার্ল্ড প্লাস নামক এক
কোম্পানির প্রধান ওয়াল্টার ওলটোজ । ওলটোজের শাশুড়িও মোটর নিউরনে ভুগছিলেন । তার
জন্যই ওয়াল্টার এটি বানিয়েছিলেন । এই প্রোগ্রামের সাহায্যে স্টিফেন হকিং আগের চেয়ে
দ্রুত অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হলেন । আঙ্গুল দিয়ে একটা সুইচ টিপে অসংখ্য শব্দগুচ্ছ
থেকে প্রয়োজনীয় শব্দ বাছাই করে সেটিকে সিন্থেসাইজারে করে যান্ত্রিক কণ্ঠ তৈরি করত
এই প্রোগ্রাম । তবে এ কাজটি করার জন্য হকিংকে হুইল চেয়ারে করে কম্পিউটারের সামনে
বসতে হত । কম্পিউটার সামনে না থাকলে তিনি আর এভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারতেন না ।

সেই
সমস্যারও একটা সমাধান পেয়ে গেলেন স্টিফেন হকিং । হকিংয়ের এক সময়ের নার্স এবং পড়ে
স্ত্রী এলিন মেসনের প্রথম পক্ষের স্বামী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ডেভিড একটি ছোট
কম্পিউটার তৈরি করে সেটাকে হকিংয়ের হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিলেন । ফলে যেকোন স্থান থেকেই
হকিং নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষা করতে সক্ষম হলেন । এর মাধ্যমে নিজের হাত ব্যবহার
করে হকিং প্রতি মিটিটে ১৫ টি শব্দ লিখতে পারতেন । যার স্পিচ সিন্থেসাইজার করে
যান্ত্রিক কন্ঠে শোনা যেত । আর এভাবেই তিনি রচনা করলেন “দ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ
টাইম” নামক বইটি । যা অতিতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে টানা ২৩৭ সপ্তাহ বেস্ট সেলার বইয়ের
তালিকায় ছিল ।

কিন্তু
দূর্ভাগ্য মনে হয় একেই বলে । একটা সময় হাতের আঙ্গুল নাড়ানোর ক্ষমতাও তিনি হারিয়ে
ফেললেন । এবারও নিয়তিকে বুরো আঙ্গুল দেখালেন হকিং । ২০০৫ সালে তিনি কপালের পেশি
নাড়িয়ে কম্পিউটার চালানো শিখে ফেললেন । আর এভাবে তিনি মিনিটে একটি শব্দ লিখতে
পারতেন । এরপর আগে পরের শব্দ অনুমান করতে পারে এমন একটি সফটওয়ার হকিংয়ের হুইল
চেয়ারের কম্পিউটারের সাথে যোগ করা হল । যার ফলে আবারও কিছুটা ভালভাবে নিজেকে প্রকাশ
করতে সক্ষম হলেন স্টিফেন হকিং । এতটা কষ্ট করেই শিক্ষার্থীদের জন্য লেকচার তৈরি
করতে প্রফেসর স্টিফেন হকিং । পড়ে ২০০৯ সালে কেমব্রিজ থেকে অবসর নেন তিনি । একই
সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার “প্রেসিডেন্সিয়াল
মেডেল অব ফ্রিডম” এ ভূষিত হন ।

এভাবেই
টানা ৫০টা বছর শুধু মানসিক শক্তির জোরে অসম্ভব্যতাকে বারবার অগ্রাহ্য করেছেন
স্টিফেন হকিং । ভেঙেছেন চিকিৎসকদের ধারণার সকল রেকর্ড । এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের
মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজির এক অধ্যাপকের মত হচ্ছে, “হকিং যেভাবে তার শারীরিক
অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন, তাতে তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার অবদান বাদ দিলেও
তার নোবেল পুরষ্কার পাওয়া উচিত ” । কিন্তু বিজ্ঞানের এতসব আবিস্কারেও তিনি তার
জীবনে নোবেল পুরষ্কার পাননি । তবে যে সম্মাননা তিনি পেয়েছেন, আইনস্টাইন ব্যাতিত
অন্য কোন নোবেল বিজয়ী তা পাননি ।

সকল দৈহিক
অক্ষমতা সত্ত্বেও শুধু মানসিক শক্তির জোরে তিনি যেভাবে অধ্যয়ন এবং তাত্ত্বিক গবেষণার
সাথে যুক্ত ছিলেন তার দৃষ্টান্তে তিনি আজও অন্যন্য । শারীরিক অক্ষমতার কথা না চিন্তা
করেলেও যেকোন বিজ্ঞান প্রেমিক আইনস্টাইনের পর সবচেয়ে প্রতিভাবান এবং প্রভাবশালী বিজ্ঞানী
হিসেবে তাকেই স্মরণ করে । তবে তার পাওয়া সাফল্য এবং কৃতিত্বস্বরূপ পুরস্কারের তালিকাটাও
অনেক লম্বা ।

একইসাথে
তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানিত ফেলো এবং পলিটিক্যাল একাডেমি অব সায়েন্সের
আজীবন সদস্য ছিলেন । সুদীর্ঘ্য ৫০ বছরের বেশি সময়কাল ধরে মোটর নিউরন রোগে ভোগার পর
২০১৮ সালের ১৪ই মার্চ ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।

এমন সব
অন্যন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে বিশ্বের কোটি মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা, উৎসাহ এবং
জীবন সংগ্রামের আর এক নাম স্টিফেন উইলিয়াম হকিং ।

জিওন আহমেদ

Leave a Reply