ব্ল্যাক
হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের নাম শোনেনি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা । বিজ্ঞান
প্রেমীদের কাছে এটা অনেক আগ্রহের বস্তুও বটে । এটা নিয়ে প্রশ্নেরও শেষ নেই ।
কিভাবে ব্ল্যাক হোল তৈরি হল ? কবে তৈরি হল ? কোথায় এদের বসবাস ? এমন হাজারো প্রশ্ন
লুকিয়ে আছে আমাদের মাঝে । আপনার যদি বিজ্ঞান নিয়ে দাঁত ভাঙ্গা কিছু প্রশ্ন করে
সবাইকে চমকে দেবেন, তাহলে ব্ল্যাক হোল নিয়ে করতে পারেন । কিন্তু আমার
ব্যাক্তিগতভাবে মনে হয়, বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের থেকে ব্ল্যাক হোল সংক্রান্ত
প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া অনেক সহজ এবং অনেক সহজেই আপনি প্রশ্নকারীকে সন্তুষ্ট করতে
পারবেন অথবা তাকে চুপ করিয়ে দিতে পারবেন । কারণ ব্ল্যাক হোলের আবিস্কারই হয়েছিল,
এক বিশাল যুক্তি তর্কের মধ্যদিয়ে । যেখানে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব নাকোচ করার মত
কোন যুক্তি ছিলনা । ব্ল্যাক হোল হল- এমন একটি মহাকর্ষীয় বস্তু, যা পদার্থবিদগণ
প্রথমে ধারণা করেছিলেন এবং তাত্ত্বিকভাবে আবিস্কারও করেছিলেন । পরবর্তীতে এর
অস্তিত্ব আবিস্কার হয় । তবে ব্ল্যাক হোল তৈরি হওয়া নিয়ে এ পর্যন্ত দুইটি ধরণের
মতবাদ আমার জানা । যাদের একটি অনেক পুরোনো যা ১৭৮৩ সালে ক্যামব্রিজের জন মিশেল
প্রস্তাব করেন । আর একটি ১৯৬০ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী জন উইলার
আমরা দুটোই জানবো
। সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করবো, যাতে ব্ল্যাক হোল পড়তে গিয়ে আপনারা বিগ
ব্যাঙে পতিত না হন ।  

১৭৮৩ সালের জন মিশেলের আবিস্কার

মুক্তিবেগ
সম্পর্কে আমরা অনেকেই পরিচিত । সাধারণত আমরা কোন বস্তুকে সোজা উপরের দিকে যেকোন
বেগে নিক্ষেপ করলে মর্ধ্যাকর্ষণের কারণে সেটির বেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং এক সময়
এর বেগ শেষ হয়ে যায় । ফলে বস্তুটি পুনরায় পৃথিবী পৃষ্ঠে ফিরে আসে । এই বেগের মান
যত বেশি বস্তুটি তত বেশি উপরে উঠবে এবং ফিরে আসবে । কিন্তু বস্তুটি যদি একটি
নির্দিষ্ট মানের বেগের চেয়ে বেশি বেগে নিক্ষেপ করা হয়, বস্তুটি আর কখনও ভূপৃষ্ঠে
ফিরে আসবেনা । সেটি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাবে
এই বেগের নাম
মুক্তিবেগ । অর্থাৎ মুক্তিবেগ হল এমন একটি বেগ, যে বেগে কোন বস্তুকে নিক্ষেপ করলে
সেটি আর পৃথিবীতে ফিরে আসবেনা । পৃথিবীর জন্য এই মুক্তিবেগের মান প্রতি সেকেন্ডে
১১ কিলোমিটার । সূর্য্যের জন্য এই বেগের মান ৬১৭ কিলোমিটার । গ্রহ বা নক্ষত্রের ভর
যত বেশি হবে, এই মুক্তিবেগের মানও তত বেশি হবে । বাস্তবে কোন বস্তুকে আমরা
মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি বা সমান বেগে নিক্ষেপ করতে পারিনা । আমাদের জন্য এই বেগ
অনেক বেশি হলেও আলোর বেগের কথা চিন্তা করলে এই বেগের মান অনেক কম । কারণ আলোর বেগ
প্রতি সেকেন্ডে ৩লক্ষ কিলোমিটার ।

সূর্য্যের
মুক্তিবেগের তুলনায় আলোর বেগ অনেক বেশি হওয়ায় তা সূর্য্য থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্ন
গ্রহ নক্ষত্রে ছড়িয়ে পরে । আলোর বেগ সূর্য্যের মুক্তিবেগের তুলনায় কম হলে তা
সূর্য্য থেকে বের হয়ে আসতে পারতো না । তাহলে আমরা হয়তো অন্ধকারে ডুবে থাকতাম । (থ্যাংক
ইউ মুক্তি বেগ, তোমার জন্য আজ আমি পদার্থবিজ্ঞান ডট কমের একজন গর্বিত পাঠক)

আগেই
বলেছি, গ্রহ নক্ষত্রের ভর যত বেশি হবে, তার মুক্তিবেগ তত বেশি হবে । কিন্তু এমন কি
কোন গ্রহ বা নক্ষত্র থাকা সম্ভব, যার ভর এতই বেশি যে তার মুক্তিবেগ আলোর বেগের
তুলনায় বেশি ? মিশেল প্রস্তাব করেন, এমনটা অসম্ভব নয় । এমন অনেক নক্ষত্র আছে, যার
ভর অনেক বেশি হওয়ায় মুক্তিবেগ আলোর বেগের তুলনায় বেশি । আর আলোর বেগ তাদের
মুক্তিবেগের তুলনায় কম হওয়ায় এসব নক্ষত্র থেকে আলো বের হয়ে তাদের মহাকর্ষের সীমার
বাইরে আসতে পারেনা । আর যেসকল বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে আসে আর আমরা যেহেতু
শুধুমাত্র তাদেরকেই দেখতে পাই, তাই এসব নক্ষত্র থেকে আমাদের চোখে আলো আসতে না
পারায় আমরা তাদের দেখতে পারিনা । একইসাথে আমরা সেই সব নক্ষত্রকে না দেখেই তাদের
পাশে চাইলেও যেতে পারবোনা । কারণ এদের ভর অনেক বেশি হওয়ায় এদের মহাকর্ষ
স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে । পাশাপাশি নিজের অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রমুখী
মহাকর্ষের কারণে তারা নিজের মধ্যেই সংকুচিত হয়ে যায় । যার ফলে তাদের আকৃতি অনেক
ছোট এবং ঘনত্ব অনেক বেশি হয়ে থাকে । মহাকর্ষ অনেক বেশি বলে, আমরা যখনই তাদের
অভিকর্ষের সীমার মধ্যে যাব তখনই তারা আমাদেরকে টেনে নেবে । যেহেতু নিউটনের
মহাকর্ষীয় সূত্রানুসারে- নক্ষত্রের ভর যত বেশি হয়, তার মহাকর্ষ তত বেশি হয় ।
একভাবে নক্ষত্রের আকার যত ছোট হয়, তার মহাকর্ষ তত বেশি হয় । একদিকে অধিক ভর,
অন্যদিকে ক্ষুদ্র আকারের কারণে এই সকল নক্ষত্রের মহাকর্ষ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক
বেশি হয় । তাই এদের মহাকর্ষের সীমার মধ্যে আমরা গেলে সেগুলো আমাদেরকে অনেক বেশি
মহাকর্ষীয় টানে, নিজেদের মধ্যে টেনে নেবে । সেই টানের পরিমাণ এমন হবে, আমরা চূর্ণ
বিচূর্ণ হয়ে যাব ।

সেক্ষেত্রে
আপনি কিভাবে চূর্ণ বিচূর্ণ হবেন, সেটা নির্ভর করছে আপনি কোন ধরণের ব্ল্যাক হোল
মরার জন্য বেছে নিয়েছেন । আপনি যদি তুলনামূলক ছোট সাইজের ব্ল্যাক হোলে যান, তবে
আপনাকে সেমাই বানিয়ে কেঁচোর মত করে নিজের মধ্যে টেনে নেবে । আর যদি আপনি বড় সাইজের
কোন ব্ল্যাক হোলে যান, আপনাকে পুরোপুরি নিজের কেন্দ্রে টেনে নেবে এবং সেখানে
আপনাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবে । তবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আপনি মারা যাওয়ার ঘটনা
দিগন্তে হালকা টাইম ট্রাভেলের সুযোগ পাবেন ।

তাহলে
দাঁড়াল তাহলে মহাবিশ্বে এমন নক্ষত্র থাকা সম্ভব, যাদের ভর অনেক বেশি কিন্তু আমাদের
কাছে অদৃশ্য থাকে এবং আমাদের ধরা ছোয়ারও বাইরে
এদেরকে আমরা
দেখিনা বলে বাদ দিয়ে কোন কিছু চিন্তা করতে পারবোনা । কারণ ভর অনেক বেশি থাকায়
সোলার সিস্টেমে এদের ভূমিকা অনেক বেশি থাকে । আবার আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ
আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে বস্তুর ভর অনেক অনেক বেশি থাকলে টা স্থান কালকে বাকিয়ে
ফেলে । যার মধ্যে আমাদের ঘটনা দিগন্ত নিয়ে অনেক কথা আছে । আর স্থান-কালের বক্রতার
মধ্যে বিজ্ঞানের অনেকগুলো রহস্য লুকিয়ে আছে ।

১৯৬০ সালের উইলারের আবিস্কার

মার্কিন
বিজ্ঞানী জন উইলার প্রস্তাব করেন, নক্ষত্রগুলো নিজেদের মহাকর্ষীয় টানে নিজের
মধ্যেই চুপসে যেতে পারে । তবে চুপসে গেলেও একটা নির্দিষ্ট অবস্থার পর এরা আর
সংকুচিত হতে পারেনা । এভাবে চুপসে গিয়ে তারা ক্ষুদ্র এবং অধিক ঘনত্বের বস্তুতে
পরিণত হয় । একদিকে আকার ছোট এবং অন্যদিকে ভর অধিক হওয়ার কারণে এদের কেন্দ্রমুখী
টান অনেক বেশি হয়ে থাকে । এদের মহাকর্ষীয় টানের সীমানাকে আমরা ইভেন্ট হরাইজন বা
ঘটনা দিগন্ত বলে থাকি । এই অধিক ঘনত্বের বস্তুগুলোর সাথে ব্ল্যাক হোলের বৈশিষ্টের
মিল পাওয়া যায় । এভাবেই উইলার ব্ল্যাক হোলের প্রস্তাব করেন । তবে ব্ল্যাক হোলের এই
মতবাদের সাথে আলবার্ট আইনস্টাইন একমত ছিলেন না ।

এভাবেই
ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব এবং রহস্যের তাত্ত্বিক প্রমাণ আমাদের হাতে চলে আসে । এরপর
বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোলের বাস্তবিক অস্তিত্ব নিয়ে ইতিবাচক ফলাফল পান । আজকে যেমন টাইম ট্রাভেলের প্রশ্নগুলো আমাদের কাছে এখনও স্বপ্নের মত, তেমনি কয়েক দশক আগে ব্ল্যাক
হোল আমাদের স্বপ্নের মত ছিল । যদিও ব্ল্যাক হোলে সার্থকতা এখনও অনেক দূরে ।

জিওন আহমেদ

Leave a Reply