প্রথমদিকে আবিষ্কৃত গ্রহগুলোর মধ্যে বৃহস্পতি অন্যতম । আকারে অনেক বড় হওয়ায় সৌরজগতে এর সুবিশাল আধিপত্য আছে । এমনকি আমাদের পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও এই গ্রহের বিশাল মহাকর্ষের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে । এই গ্রহ ছাড়া পৃথিবী কিংবা আমাদের অস্তিত্ব, কোনটিই সম্ভব নয় । শুধু মহাকর্ষ দিয়ে নয় বরং পৃথিবীর দিকে ছুটে আসা উল্কাপিন্ডকে আকর্ষন করে নিজের মধ্যে নিয়ে নেয় এই বৃহস্পতি । আকারে এত বড় গ্রহটিকে রাডার টেলিস্কোপ দিয়ে দেখার সময় এটি অদৃশ্য হয়ে যায় । এমন হয়ে যায়, যেন বৃহস্পতি সেখানে নেই । যদিও বৃহস্পতির উপগ্রহগুলো টেলিস্কোপে স্পষ্ট দেখা যায় । তাহলে এই গ্রহে অবতরণ করলে কেমন হয় ? কিন্তু এই গ্রহে আমরা কখনই অবতরন করতে পারব না । কেন ?

আপনি হইতো শুনে থাকবেন, আমাদের সৌরজগতে দুইটি গ্যাসের জার আছে । একটি হল- শনি আর একটি বৃহস্পতি । আর ইউরেনাস এবং নেপচুন হল বরফের জার । অর্থাৎ আমাদের পৃথিবীর মতো বৃহস্পতি গ্রহে কোন কঠিন ভূপৃষ্ঠই নেই‍ । আছে কেবল বিভিন্ন গ্যাসে ভর্তি একটি বৃহৎ বায়ুমন্ডল যেখানে দানবাকার রঙিন মেঘ, বজ্রপাত ও সমগ্র পৃথিবীকে শুষে নেবার ক্ষমতাসম্পন্ন বৃহদাকার ঘূর্ণিঝড় সর্বদা চলমান‍! কি হবে যদি কোনো নভোচারী অত্যাধুনিক মহাকাশযানে করে এর অভ্যন্তরে যাবার চেষ্টা করে ? তার উত্তর সত্যি রোমাঞ্চকর !

প্রথমত এই গ্রহে আপনি প্রচলিত স্যান্ডার্ড স্পেসশুট পরে যদি যান‍ তবে সেখানে আপনি প্রবেশই করতে পারবেন না । কারন গ্রহের 3,00,000 কি.মি এর আশেপাশে আসা মাত্রই এর রেডিয়েশন আপনার জৈবিক দেহকে একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলবে ‍। ধরুন এই সমস্যা থেকে বাঁচতে নভোচারীকে একটি শক্তিশালী কাল্পনিক রেডিয়শনরোধী শ্যুট পড়ানো হলো‍ । যার ফলে তিনি এই রেডিয়েশন থেকে বেঁচে গেলেন । তাহলে কি তিনি নিরাপদ ? না !

বৃহস্পতি গ্রহের কাছাকাছি যাবার পর এর বিশাল অভিকর্ষে প্রতি ঘন্টায় ১৮০,০০০ কি.মি বেগে আমরা এর ভেতরে চলে যাবো । গ্রহের ভিতরে ২৫০ কি.মি যাবার পর আমরা প্রবেশ করবো প্রায় -১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার অ্যামোনিয়ার মেঘের রাজ্যে । এখানে এলেই ঘন্টায় ৪৮২ কিলোমিটার বেগের হাওয়া আমাদের দোলা দিয়ে যাবে আর চোখের সামনে দৃশ্যমান হবে লাল নীল বিভিন্ন রঙের ঘূর্ণিঝড় ।

আরো ১২০ কি.মি নিচে গেলে প্রতিকূলতা আরও কয়েক গুণ হয়ে যাবে । ১৮৮৯ সালের ১৮ই অক্টোবর বিশেষভাবে ডিজাইন করে পাঠানো হয় নাসার গ্যালিলিও স্পেস ক্রাফট যা ১৯৯৫ সালের ৭ই ডিসেম্বর বৃহস্পতির অরবিটে সফলভাবে ঢুকে পড়ে । কিন্তু এর শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্রের সাথে ঠিকে থাকতে পারেনি গ্যালিলিও টেলিস্কোপ । ১৯৯৫ সালে সর্বোচ্চ এই গভীরতায় এসে বায়ুমন্ডলের চাপে ধ্বংস হয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়‍ । এখানে বায়ুর চাপ পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের বায়ুর চাপের ১০০গুন বেশি এবং সূর্যের আলো এই গভীরতায় না আসায় অন্ধকারে একেবারে আপনি ডুবে যাবেন ।

বৃহস্পতির চুম্বকক্ষেত্র আমাদের কাল্পনিক চুম্বকত্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি । যা এতটাই শক্তিশালী যে, এটি সূর্য্য থেকে বেড়িয়ে আসা মারাত্মক সৌরঝড়কে আটকে ফেলে । গ্যাসের একটি গ্রহের এত শক্তিশালী চুম্বকত্ব বিজ্ঞানীদের রীতিমত অবাক করে দিয়েছিল ।

আরও ৭০০ কিলোমটার নিচে বায়ুর চাপ ১১৫০ গুন বেশি ! এখানে টিকে থাকতে গেলে প্রয়োজন হবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ গভীরতার যেতে সক্ষম Trieste সাবমেরিন‍ । এর আর একটু গভীরে গেলেই পৃথিবীর সাথে আপনার সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে কারন এখানকার বায়ুমন্ডল রেডিও ওয়েভ তরঙ্গ শুষে নিতে সক্ষম‍ ।

আরও ৪,০০০ কিলোমিটার নিচে তাপমাত্রা ৩৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ! অর্থ্যাৎ এই গভীরতায় ইউনিভার্সের সর্বোচ্চ গলনাঙ্কের মৌল টাংস্টেনও গলে যাবে !

২১,০০০ কিলোমিটার নিচে চাপ পৃথিবীর চেয়ে ২ মিলিয়ন গুন বেশি  এবং তাপমাত্রা সূর্যের পৃষ্ঠের থেকেও বেশি‍ । এই পরিস্থিতি এতোটাই ভয়ঙ্কর যে এখানে হাইড্রোজেনের রসায়নও বদলে যায় ! এতো শক্তির প্রভাবে হাইড্রোজেনের ইলেকট্রন ঘনিভূত হয়ে এক অস্বাভাবিক পদার্থ “Metalic hydrogen” গঠন করে! এটি অত্যন্ত প্রতিফলন ক্ষমতা সম্পন্ন তাই এখন আর লাইট ব্যবহার করে লাভ হবে না! এই মেটালিক হাইড্রোজেন যথেষ্ট ঘন‍ । এর ভেতরে প্রবেশ যদি করি তবে এর প্লবতা আমাদের ওপরের দিকে ঠেলবে‍। অন্যদিকে গ্রাভিটি টানবে নিচের দিকে‍ । আর দুটো ফোর্স সমান হলে আমরা ঐ স্থানে আটকে থাকবো অনন্তকালের জন্য‍ ।

আমাদের যাত্রা এই পর্যন্তই‍ ! এর বেশি হয়তো আমরা কোনোদিনই জানতে পারবো না‍ । দেখতে পারবো না কি রহস্য রয়েছে এই ভয়ংকর রঙীন মেঘের এর গভীরে‍ ।

Leave a Reply