যদি বলি, দুনিয়াকে পাল্টে দেওয়ার জন্য এক নিকোলা টেসলাই যথেষ্ট, তাহলে কি খুব বেশি অবাক হবেন ? সায়েন্স ফিকশন কিংবা মুভিতে অবাস্তব একটি মেশিন দেখে আমরা মাঝে মধ্যেই আমাদের বাস্তব জীবনের সীমাবদ্ধতা চিন্তা করতে শুরু করি । আমরা সেখানে আকাশ কুসুম চিন্তা করিনা । কারণ আমরা জানি, তা বাস্তবে সম্ভব নয় । কিন্তু আপনার আমার জন্য যা সম্ভব নয়, সবার জন্য যে তাই তা কিন্তু নয় । একজন ব্যাক্তি, যার জন্য বিশ্বের অনেক কিছুই সম্ভব । তার ছাড়াই সবাইকে বিদ্যুৎ বিতরণ, কৃত্রিম ভূমিকম্প, কৃত্রিম ঢেউ ইত্যাদি এসবই যার জন্য বাস্তবতা । তিনি নিকোলা টেসলা । যার চিন্তা আমাদের সায়েন্স ফিকশন কিংবা মুভিকেও হার মানায় ।

পৃথিবীর ইতিহাসে সব থেকে রহস্যময় ও বিস্ময়কর বিজ্ঞানী ছিলেন নিকোলা টেসলা । যিনি আমাদের পৃথিবীরটাকে আধুনিক করে দিয়ে গেছেন । তবে আমরা অনেকেই অনেককিছুই জানিনা তাঁর আবিষ্কার সম্পর্কে । যার ছিল ৩০০ টির বেশি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট এবং তাঁর আবিষ্কারগুলো ছিল সময়কে ছাপিয়ে গিয়ে সে সময় থেকেও অনেক অনেক আধুনিক যা বর্তমান যুগেও আধুনিক হিসাবে বিবেচিত হয় । তাঁর এমনও আবিষ্কার ছিল যা পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে । কিন্তু মানব কল্যাণের জন্য তিনি সেই আবিষ্কারগুলোকে নষ্ট করে দেন । বিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি এমন এক ব্যাক্তিত্ব হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন, যাকে অনেকেই চিনেনা । কিন্তু তার সম্পর্কে যিনিই জানতে পারেন, তিনিই তাকে শ্রেষ্ট মনে করেন । কারন নিকোলা টেসলা একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি যা চিন্তা করতেন তাই-ই তৈরি করে দেখাতেন । এজন্যই অনেকেই তাঁকে ইতিহাসের সবথেকে পাগলাটে বিজ্ঞানী বলে আখ্যা দিয়েছিলো ।

নিকোলা টেসলার জন্মশৈশব এবং শিক্ষা

নিকোলা টেসলার জন্মই ছিল রহস্যময় । প্রচণ্ড প্রতিকূল আবহাওয়া এবং বজ্রপাতের রাতে ক্রয়োশিয়াতে ১৮৫৬ সালে ৯ জুলাই এবং ১০ জুলাইয়ের মাঝে রহস্যময়ভাবে ঠিক রাত 12:00 টায় তাঁর জন্ম হয় । তাই তাঁর জন্ম তারিখ ২ টি বলা হয়ে থাকে । তবে অনিশ্চয়তা এড়াতে উইকিপিডিয়াতে ৯ ও ১০ই জুলাই এর পরিবর্তে ১০ই জুলাই লেখা হয়েছে । খারাপ আর ভয়ঙ্কার আবহাওয়াতে জন্ম বলে মানুষ তাঁকে “চায়েল্ড অফ ডার্কনেস” বলেছিল । কিন্তু তাঁর মা বলেছিলেন সে একদিন পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করবে , তাই তিনি তাঁকে “চায়েল্ড অফ লাইট” বলতেন ।

বাস্তবেও টেসলা তাই করেছিলেন । তাঁর আবিষ্কৃত এসি বিদ্যুৎ পুরা পৃথিবীকে শুধু আলোকিতই করেনি, বরং আমাদের একটা আধুনিক প্রযুক্তি বিপ্লবের পৃথিবী দিয়েছে । যার মাধ্যমে শুধু আজ নয় বরং আগামীর পৃথিবীতে যত আবিষ্কার আসবে তার প্রতিটিতে তার অবদান এবং অংশীদারিত্ব স্থাপন করবে ।

নিকোলা টেসলাকে তার বাবা ধর্মযাজক বানাতে চেয়েছিলেন । পাঠিয়েও দিয়েছিলেন ধর্মযাজকদের কাছে । কিন্তু কিছুদিন পর কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পথ থেকে বেঁচে আসেন তিনি । এরপর পারিবারিকভাবে তাঁকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর পরিকল্পনা করা হয় ।

স্কুল এবং কলেজ জীবনেই তিনি তাঁর প্রতিভার বিস্ময় দেখাতে শুরু করেছিলেন । বড় বড় ত্রিকোনামিতিক ক্যালকুলাস তিনি খাতা কলম ছাড়াই ব্রেইনে চিন্তা করেই উত্তর বলে দিতেন । তিনি এতোটাই মেধাবি ছিলেন যে কলেজের শিক্ষকরা তাঁর বিস্ময়কর মেধা দেখে তাঁর বাবাকে চিঠি দিত ।

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ে এক শিক্ষকের সাথে তাঁর কোন একটা বিষয় নিয়ে দ্বিমত হয় । পরে তিনি প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা ল্যাবে কাজ করে প্রমান করেন যে তাঁর ধারনাই সঠিক । এই ঘটনা কলেজে ছড়িয়ে পড়লে তিনি সকলের কাছেই আরও বেশি বিস্ময়কর ছাত্র হয়ে ওঠেন । কিন্তু তখনও তাঁর প্রকৃত আবিষ্কারের আসল বিস্ময় শুরু হয়নি ।

1884 সালে নিকোলা টেসলা আমেরিকা পারি জমান । সাথে তার পরিচয় পত্র আর টমাস এডিসনকে লিখা একজনের একটা চিঠি যেটা নিকলা টেসলাকে বলা হয়েছিল এডিসনকে পৌঁছে দিতে । সেই চিঠিটাতে লিখা ছিল- আমি পৃথিবীতে দুইজন জ্ঞানী ব্যাক্তিকে চিনি, একটা তুমি এডিসন এবং অপরটি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিকোলা টেসলা ।

এসি এবং ডিসি (এডিসন বনাম টেসলা)

এডিসন তাঁর কোম্পানিতে নিকোলা টেসলাকে নিয়োগ করেন এবং ডিসি জেনারেটর পুনরায় ডিজাইন করার জন্য তাঁকে ৫০,০০০ ডলার দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন । নিকোলা টেসলা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সফল হন । কিন্তু এডিসন নিকোলা টেসলাকে কোন টাকাই দেননি এবং বলেন “It’s a Joke” । এর মাঝেই নিকোলা টেসলা আবিস্কার করেন সব থেকে বিস্ময়কর আবিষ্কার যা সারা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল । আর সেটি হল এসি বিদ্যুৎ বা পরিবর্তী বিদ্যুৎ প্রবাহ .

এডিসনের ডিসি বিদ্যুৎ দিয়ে মানুষ শুধু আলো পাবার চিন্তা করত । কিন্তু নিকোলা টেসলা এর আবিষ্কৃত এসি দিয়ে সব কিছু করা সম্ভব এটা মানুষ বুঝতে পারে । নিকোলা টেসলা এডিসনকে এসি এর পরিবর্তে এসি ব্যবহার করতে পরামর্শ দেন । কিন্তু ডিসি কারেন্ট যেহেতু এডিসনের যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল তাই টেসলার এমন প্রস্তাবে এডিসন ক্রিপ্ত হন । এক সময় টেসলা এডিসনের কোম্পানি থেকে আলাদা হয়ে “টেসলা ইলেকট্রিক কোম্পানি” নামে নতুন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন ।

নিকোলা টেসলা
টেসলা ইলেকট্রিক কোম্পানির লেবেল

টেসলার নতুন কোম্পানির এসি বিদ্যুৎ খুব শীঘ্রই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । কারন এসি ছিল অত্যন্ত পাওয়ারফুল এবং কম খরচে পাওয়া যেত । শিল্প কারখানার কাজেও একমাত্র ব্যবহার উপযোগী ।

এদিকে এডিসনের ডিসি বিদ্যুতে ব্যবসা প্রায় শেষ । এডিসন নিকোলা টেসলাকে থামাতে স্থায়ীয় বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে কুকুর, বিড়াল এনে রাস্তায় রাস্তায় ক্যাম্প বানিয়ে সেগুলোকে এসি বিদ্যুতের শক দিয়ে জন সম্মুখে হত্যা করে মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি করতে লাগলেন । একজন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিকেও এসি কারেন্টের শক দিয়ে হত্যা করার জন্য প্রশাসনকে বোঝান ।

এই ঘটনাগুলো ঘটিয়ে মানুষের মনে ত্রাস সৃষ্টি করে এডিসন নিকোলা টেসলার কোম্পানিকে চরমভাবে আর্থিক বিপর্যয়ে ফেলেন এবং একসময় নিকোলা টেসলা এসি বিদ্যুতের প্যাটেন্ট বিক্রি করে দেন । প্যাটেন্ট বিক্রির 60,000 ডলার দিয়ে তিনি নতুন আবিস্কারের পেছনে কাজে লাগান ।

নিকোলা টেসলা

কিন্তু মানুষ পরবর্তীতে ঠিকই এসি বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে এবং পুরা শহরে এসি বিদ্যুতের জন্য একটি কোম্পানি এডিসনের বিদ্যুৎ কোম্পানিকে বরাদ্দ করে । এটি ছিল এডিসনের জন্য চরম লজ্জাজনক । তিনি করবেন না বলে জানিয়ে দেন । এ কারণেই এডিসনের কোম্পানির অন্যান্য শেয়ার হোল্ডাররা এডিসনের কোম্পানি থেকে এডিসনকেই বের করে দেন ।

মানব কল্যাণে নিকোলা টেসলা এর যুগান্তরকারী আবিষ্কার গুলো

300 এর বেশি আবিস্কারের প্যাটেন্ট ছিল এই মহান বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার । এছাড়াও অনেক আবিস্কারের প্যাটেন্টই গ্রহন করেননি । সব মিলিয়ে আবিষ্কারই ছিল তাঁর নেশা । তার সব আবিষ্কারগুলোর মধ্যে কিছু আবিষ্কারের নাম উল্লেখ করছি-

  • এসি কারেন্ট ।
  • রেডিও ।
  • রিমোট, রোবট, গাইডেড মিশাইল সিস্টেম ।
  • তার বিহীন বিদ্যুৎ ।
  • ইন্ডাকশন মোটর ।
  • টেসলা কয়েল ।
  • টেলিফোর্স ।
  • ভায়োলেট রশ্মি ।
  • নিয়ন বাতি ।
  • ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি ।
  • থ্রি ফেস ইলেকট্রিক পাওয়ার ।
  • টেসলা টার্বাইন ।
  • টেসলা ভালভ ।
  • ভ্যাকিউম ভেরিয়েবল ক্যাপাসিটর ।
  • স্যাডোগ্রাফ ।
  • ফ্রি এনার্জি ।
  • টেসলা এক্সপেরিমেন্টাল ।
  • টেসলাস এগ অফ কলম্বাস ।
  • রেজোন্যান্ট ইন্ডাক্টিং কাপলিং ।
  • পলিফেস সিস্টেম ।
  • ঘূর্ণায়মান চুম্বক ক্ষেত্র ।
  • রেডিও কন্ট্রোল ।
  • প্লাজমা গ্লোব ।
  • থট ক্যামেরা ।
  • কৃত্রিম ঢেউ তরঙ্গ ।
  • কৃত্রিম ভূমিকম্প মেশিন ।
  • অ্যান্টি গ্র্যাভিটি ফ্লাইং ম্যাচিং ।

টেসলার প্রতিটি আবিষ্কার ছিল এক একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার । সেসবের মাঝে এসি কারেন্ট, তারবিহীন বিদ্যুৎ, ভূমিকম্প মেশিন ইত্যাদি ছিল এমন আবিষ্কার যা বাস্তবায়িত হলে আমাদের এই দুনিয়াটা আজ অন্যরকম দেখতে হত ।�

নিকোলা টেসলা

কে জানে, হয়তো গাড়িতে কিংবা অফিসে বসেই কোন চার্জার ছাড়াই আপনার ফোনটিকে চার্জ করতে পারতেন । এসবই ছিল টেসলার আবিষ্কারের চমক । কিন্তু একজন আবিস্কারক চাইলেই তার আবিষ্কার বাস্তবায়ন করতে পারেন না । দেশের বিজনেস সেই মূহুর্তে কি ডিমান্ড করে, বিজনেসম্যানরা কি ডিমান্ড করছে সেটাও এক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় । 

Leave a Reply