ধর্ম এবং বিজ্ঞান নিয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন
বলে গেলেন, “ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু এবং বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ ।” আবার স্টিফেন
ডব্লিউ হকিং বলছেন, “স্রষ্ঠা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু পৃথিবী সৃষ্টির জন্য তার
কোন প্রয়োজন নেই ।” আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে তিনি আরও উল্লেখ করছেন, “আমাদের সম্পর্কে
সত্যটি হল এটাই- আমরা মানুষ, যারা প্রকৃতির মৌলিক কণাগুলোর নিছক সংকলন মাত্র । আর
এই জায়গাটি থেকে আমরা আমাদের মহাবিশ্ব পরিচালনাকারী সূত্রগুলোকে যতটুকু বুঝতে
পেরেছি, তা আমাদের অনেক বড় বিজয় ।”
১২ বছর বয়সে আলবার্ট আইনস্টাইন বেশ ধার্মিক
হয়ে উঠেছিলেন । স্রষ্টার গুণ-কীর্তন করে বিভিন্ন গান ও পঙক্তি রচনা করেছিলেন । তথাপি
বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়ার পর তার এই ধর্মীয় চেতনা কমে যেতে থাকে । কারণ ধর্মীয়
বিশ্বাসের সাথে তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের একটা বিরোধ লেগে যাচ্ছিল । আর সেই
বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো ছিল নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত । জীবনের পরবর্তী সময়ে তিনি তার গড
লেটারে উল্লেখ করেন, “আমার কাছে ঈশ্বর শব্দটি আর কিছুই না, এটা শুধু মানুষের
দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র ।”
বিজ্ঞান এবং ধর্ম নিয়ে ইতিপূর্বে যারাই
আলোচনা করেছেন, তারা অনেকেই অনেক নির্মম পরিণতির স্বীকার হয়েছেন । যেমন
গ্যালিলিওকে কারাগারে জীবন দিতে হয়েছে । জিওর্দানো ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা
হয়েছে । অথচ যেসব কারণে তাদের এই নির্মম পরিণতি, সে সব তত্ত্বই এখন স্বীকৃত এবং
প্রমাণিত । আর যারা এই নির্মম কাজগুলো করেছে তারা সবাই ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস
থেকেই তা করেছেন । ইতিহাসে এমন নির্মম শিক্ষা থেকেও আমাদের অনেকের মধ্যে কোন
বোধশক্তি জন্ম নেয়নি । আমি ধর্মকে অবিশ্বাস কিংবা বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করতে বলছিনা ।
বলতে চাচ্ছি, সত্যকে সত্য বলে মেনে নেয়া এবং ধর্ম এবং বিজ্ঞানের এই সম্পর্ককে
বিরোধের চোখে না দেখতে ।
যদি বেশি জটিল করে না ভাবি, আপনি একটু
চিন্তা করুন-আজ থেকে ঠিক ৫০০ বা ৬০০ বছর আগে কি মানুষগুলো দেখতে বর্তমানের মানুষের
মত ছিল ? নিশ্চয়ই না । তাদের রূপ এবং শারীরিক গঠন বর্তমানের মানুষের থেকে ভিন্ন
ছিল । সময় ব্যাবধানটাকে যদি আরও একটু বাড়িয়ে ২০০০ বা ৩০০০ বছর আগে চলে যাই তাহলে
হয়তো ব্যবধানটা আরও অনেক বেশি দৃষ্টিগোচর হবে । মানুষের সেই রুপের সাথে বানরের
রুপের কিছু মিল আসলেও আসতে পারে । তখন আমি বলব, মানুষ বানরের মত ছিল । কিন্তু
মানুষের যদি এই বিবর্তনের পরিবর্তন হয়ে থাকে, বানরেরও নিশ্চয়ই হয়েছে ? বানর হয়তো
সে সময় দেখতে অন্য রুপের ছিল । তাই আমি যদি বলি, মানুষের আদিম রূপ বর্তমানের
বানরের মত ছিল তাহলে হয়তো খুব একটা বেশি ভুল হবেনা । এটা নিছক একটা রুপের
বৈশিষ্ট্য মাত্র । ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব এটা না হলেও সেটাকে যদি আমরা এভাবে
চিন্তা করি তাহলে হয়তো আমাদের খুব একটা বেশি ভুল হবেনা ।  এটা মেনে নিলে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে খুব
একটা বেশি বিরোধ চলে আসেনা । কারণ ধর্ম বলছে, মানুষের আদিম জাত মানুষই ছিল এবং
স্রষ্টা সরাসরি মানুষকেই বানিয়েছেন । আর আমি শুধু উল্লেখ করেছি, এই মানুষগুলো
পূর্বে দেখতে কিছুটা বানরের মত ছিল । বানর ছিল এমনটা নয় । যাই হোক আমি নিছক একটি
উদাহরণ দিয়েছি মাত্র । আর ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব সত্য প্রমানিত হলেও পরবর্তিতে
এই তত্ত্বেরও কিছু ভুল আসতে পারে ।
বিজ্ঞানের একটা মূল বৈশিষ্ট হল-বিজ্ঞান কোন
কিছুকে দেখেও বিশ্বাস করেনা, যতক্ষণ তা তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত না হয়েছে । আর
বিজ্ঞান এটাও মানে, বিজ্ঞান যা জানে তার বাইরেও আরও অনেক কিছু জানার আছে । বিজ্ঞান
আরও বলছে, আমরা যা দেখছি বা যা আছি তাই যে পুরোপুরি সত্য, এমনটা নয় । এই সৃষ্টিতে
সবই আপেক্ষিক, কোন কিছুই পরম নয়
কাজেই বিজ্ঞান যাই বলছে তা কোন না কোন বস্তু বা ঘটনার
সাপেক্ষে । প্রসঙ্গ কাঠামো ভিন্ন হলে তার উক্তিও ভিন্ন হয়ে যেতে পারে । স্টিফেন
ডব্লিউ যেহেতু বলেই দিয়েছেন, আমরা শুধুই মৌলিক কণাগুলোর সংকলন । তাই আমরা নিজেরা
সেই মৌলিক কণার সংকলন হয়ে অন্য সকল কণার রহস্য জানার চেষ্টা করছি, তাদের অতীত এবং
ভবিষ্যৎ জানার চেষ্টা করছি । পাশাপাশি তাদের ব্যবহার করে নিজেদের কল্যাণে প্রয়োগ
করছি । আর এসব যা দিয়ে করছি, তা হল বিজ্ঞান । এখানে না বিজ্ঞান কোন ধর্ম, না কোন
ভিন্ন গোত্র আর না তো কোন ভিন্ন সংগঠন । বিজ্ঞান শুধু মানুষকে সত্যিটা দেখাতে চায়
। মানুষের বিশ্বাসের রহস্যকে বিশ্লেষণ করে সত্যের পথ দেখাতে চায় ।
বিজ্ঞান সন্দেহ নয়, প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ।
বিজ্ঞান আজও প্রশ্ন করে, আপনি রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আপনার প্রিয় ঘড়িটি কি
আসলেই সেখানে থাকে ? নাকি আপনি না থাকলে তার কোন অস্তিত্ব থাকেনা ? আপনি ফিরে আসলে
সেটা আবার আপনার সামনে একটি প্রতিকৃতি ভেসে ওঠে । এমনটা যে হবেনা, তার বিশ্বাস কি
? প্রমাণই বা কি ?
ধর্ম মানুষকে বলে, তাকে না দেখে বিশ্বাস করতে
হবে বা স্বীকার করে নিতে হবে । কিন্তু বিজ্ঞানের ধর্ম এটাই, সে কোন কিছু বিনা
প্রমাণে মেনে নেবেনা । এখানেই বিজ্ঞান এবং ধর্মের মাঝে একটা ব্যবধান । আবার মাঝে
মাঝে বিজ্ঞান তার যুক্তি তর্কে এমন কিছু বিষয় দ্বার করায় যা হয়তো ধর্ম গ্রন্থে বলা
নেই বা অন্যভাবে বলা আছে । আমরা ধার্মিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটাকে নাস্তিকতা বা
বিপথগামিতা হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি । যার জন্য আমরা অনেক হিংস্র রুপও ধারণ করি ।
এমন অনেক কালো ইতিহাস আমরা রচনা করেছি । যা আমি মহাকাশবিদ্যার ইতিহাস বর্তমান এবং
ভবিষ্যৎ আর্টিকেলেও তুলে ধরেছি । কিন্তু বিজ্ঞান তো আগেই বলে দিয়েছে, এখানে পরম
বলতে কিছু নেই । এখানে পরিবর্তন আসতে পারে । আবার নাও আসতে পারে । আমি তো সর্বদাই
এটা বিশ্বাস করি, সৃষ্টির পর থেকে এই মহাবিশ্বে একটি জিনিস আজও ধ্রুবক আছে, তা হল
পরিবর্তন । পরিবর্তন আসবেই ।
আবার আমাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই বিজ্ঞানকে
নাস্তিকতা মনে করি । অথবা মনে করি, নাস্তিকরা বিজ্ঞান পড়ে নাস্তিক হয়েছে । কিন্তু
বিজ্ঞান কখনই কাঊকে তার বিশ্বাস নিয়ে কথা বলেনি । তাকে নাস্তিক বা আস্তিক হতে বলেনি
। বিজ্ঞান তার নিজের পথে অটুট থেকেছে । আপনার না দেখে সেই বিশ্বাস করার জায়গাটা
আপনার কাছে । এখানে বিজ্ঞানের কোন হস্তক্ষেপ নেই ।
এবার আসি স্রষ্ঠার অস্তিত্ব নিয়ে । বিজ্ঞান
মাঝে মাঝেই স্রষ্ঠার অস্তিত্ব আছে কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন করে । আবার ধর্ম
গ্রন্থে বলে, যাতে আমরা স্রষ্ঠার অস্তিত্ব নিয়ে না ভেবে তার সৃষ্টির অস্তিত্ব নিয়ে
ভাবি
তাই
বিজ্ঞানের এই কাজটিকে আমরা বিশ্বাসীরা একটু সহজে মেনে নিতে পারিনা । আমি আগেই
বলেছি, বিজ্ঞান কোন ধর্ম বা বিশ্বাস বোঝেনা । বিজ্ঞান তার নিজের বৈশিষ্টকে
অক্ষুন্ন রেখে চলে ।
ধর্ম আর বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলার সময় অনেক
জটিলতার স্বীকার হতে হয় । একদল আমায় অতি ধার্মিক, এক দল নাস্তিক আর এক দল ইমান
হারানোর কথা বলে । আমার কথার অস্পষ্টতার কারণে কিছু বুঝানোর ত্রুটি থাকতে পারে ।
তবে এ ব্যাপারে কিছু কথা বলে শেষ করব ।
ডাঃ জাকির নায়েক তার অনেক লেকচারে উল্লেখ
করেছেন, এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান যা কিছু আবিষ্কার করেছে বা প্রমাণ করেছে তার ৮০%
ইসলাম ধর্মের আল কুরআনের সাথে মিলে যায় এবং উনি বিশ্বাস করেন, বাকী ২০% ও কোন
একদিন মিলে যাবে । তাই তিনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন ।
উপরে আলবার্ট আইনস্টাইনের ধর্ম সম্পর্কিত
মতবাদ সম্পর্কে লিখেছিয়াম । এখন উনি যে যুক্তিতে ধর্মে অবিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেছেন,
তার সাথে বিতর্কে যাওয়ার পর্যাপ্ত পরিমাণ ধর্মীয় এবং বিজ্ঞানের জ্ঞান আমার নাই ।
তবুও তার যুক্তির ৬০% জবাব আমি দিতে পারব এবং আমি বিশ্বাস করি, জ্ঞানের পরিধি
বাড়াতে পারলে আমি কোন এক সময় বাকি ৪০% যুক্তিও খণ্ডন করতে পারব । তাই সেই বিশ্বাস
থেকে আমি কুরআনে বিশ্বাস করি এবং আমি একজন মুসলমান ।
লেখক
জিওন আহমেদ
ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং
(ইইই)
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)
ব্যাসেট

Leave a Reply