পুরো নাম- জাবির ইবনে হাইয়ান আল-আজদি আস সুফি আল-ওমাবি। আরবের দক্ষিণাংশের বাসিন্দা আজদি গোত্রের হাইয়ান ছিলেন তাঁর পিতা । তিনি ছিলেন আরব আযদ উপজাতির একজন ফার্মাসিস্ট যিনি উমাইয়া খিলাফতের সময় ইয়েমেন থেকে কুফাতে চলে যান । চিকিৎসক পিতার সন্তান হলেও সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে উমাইয়া খলিফা তাঁর পিতাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করলে বাল্যকালে তিনি চরম দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হন । শৈশবে কুফায় বসবাস করলেও পিতার মৃত্যুর পর তিনি দক্ষিণ আরবে স্বগোত্রে ফিরে আসেন । জাবির ইবনে হাইয়ানের প্রকৃত জাতীয়তা নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে । কেউ তাকে আরবের এবং কেউ তাকে পারস্যের নাগরিক মনে করে থাকেন ।

কুফায় বসবাসের সময় তিনি রসায়ন শাস্ত্র গবেষণায় বিশেষ মনোযোগী হন । ওই পরিপ্রেক্ষিতে কুফায় একটি রসায়ন গবেষণাগারও প্রতিষ্ঠা করেন । মুসলিম ঐতিহাসিকরা ওই গবেষণাগারকে পৃথিবীর প্রথম রসায়নাগার বলে অভিহিত করেছেন । পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রসায়নের প্রাথমিক প্রক্রিয়াগুলো চর্চা করার উপায় উদ্ভাবন করেন । তাই তাকে ‘রসায়নের জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় । পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন শাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি চিকিৎসা, খনিজ পদার্থ, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রকৌশল প্রভৃতি বিষয়ে অবদান রাখেন । তিনি প্রায় ৩ হাজার বই রচনা করেন । এর মধ্যে চিকিৎসা বিষয়ক বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫০০টি । তার দ্য বুক অন ব্যালেন্স গ্রুপে বিখ্যাত ‘প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য তত্ত্ব’ উল্লেখিত রয়েছে ।

আধুনিক রসায়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছিলেন জাবির ইবনে হাইয়ান । যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- পাতন, কেলাসন, ধাতুর শোধন, তরলীকরণ, বাস্পিকরন, হাইড্রোক্লোরিক ও নাইট্রিক এসিড সংশ্লেষণ । এছাড়া তিনিই সর্বপ্রথম ইস্পাত তৈরি করার পদ্ধতি, চামড়া ও কাপড়ে রঙ করার প্রনালী আবিষ্কার করেছিলেন । লোহার মরিচা রোধক বার্নিস তারই আবিষ্কার । এমনকি চুলের কলব, কাঁচ, লেখার কালিতে তার অবদান রয়েছে ।

জাবির ইবনে হাইয়ান বস্তু জগতকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করেন । প্রথম ভাগে স্পিরিট, দ্বিতীয় ভাগে ধাতু এবং তৃতীয় ভাগে যৌগিক পদার্থ । তার আবিষ্কারের উপর নির্ভর করেই পরবর্তী বিজ্ঞানীরা বস্তুজগতকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেন । তিনি এমন কিছু বস্তু বিশ্ব সভ্যতার সামনে তুলে ধরেন যেগুলো কঠিন অবস্থা থেকে তাপ দিলে তরল না হয়ে সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয় । যাদের মধ্যে কর্পূর, আর্সেনিক এবং অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড উল্লেখযোগ্য । এছাড়া নির্ভেজাল বস্তুর মাঝে তুলে ধরেন সোনা, রূপা, তামা, লোহা, দস্তা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।

জাবির ইবনে হাইয়ান সর্ব প্রথম নাইট্রিক এসিড তৈরি করেন । এমনকি সালফিউরিক এসিডও তার আবিষ্কার । কিতাবুল ইসতিতমাসে তিনি নাইট্রিক এসিড তৈরির ফর্মুলা বর্ণনা করেন । নাইট্রিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডের মিশ্রনে স্বর্ণ গলানোর পদার্থটির নাম “একোয়া রিজিয়া” তারই দেওয়া । জাবির ইবনে হাইয়ান স্বর্ণ ও পরশ পাথর তৈরী করতে পারতেন । কিন্তু তিনি স্বর্ণ কিংবা পরশ পাথরের লোভী ছিলেন না । ধন সম্পদের লোভ লালসা তাঁকে সভ্যতা উন্নয়নে ও গবেষণার আদর্শ থেকে বিন্দু মাত্র্ব পদস্খলন ঘটাতে পারেনি ।

জাবির ইবনে হাইয়ানের অধিকাংশ রচনাই দুর্বোধ্য এবং সাংকেতায়িত । তিনি কি লিখেছেন তা বোঝা সবার পক্ষে সম্ভব নয় । বিশেষজ্ঞগণ কিছুটা বুঝতে সক্ষম হন । তাক্কিনের ধারণা এবং সে সময় আরবে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদার্থের নামের মাধ্যমে তিনি বিস্তৃত রাসায়নিক সংখ্যায়ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন ।

Leave a Reply