উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব : নব বিজ্ঞানের সূচনা নিয়ে লিখেছেন তানভীর আহমেদ নীলয়
উদ্ভিদ, সৃষ্টিকর্তার এক অভিনব সৃষ্টি।
এই নিশ্চল নির্বাক সৃষ্টিটিরও জীবন আছে, অনুভূতি আছে এমনকি তাদের শরীরেও বাসা বাধতে
পারে দুরারোগ্য ব্যধি। উদ্ভিদের রোগ বা ব্যধি মানুষের জন্য চিন্তার কারন ছিল সেই প্রাচীন
কাল থেকেই। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত
হয়
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। সময়ের হিসেবে
বলতে গেলে বিজ্ঞানের নতুন একটি শাখা এটি।
প্রাচীনকালে উদ্ভিদের রোগ নিয়ে এক ধরনের
রহস্য ছিল। ধার্মিকদের বিশ্বাস ছিল রোগ আসে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে মানুষের কৃতকর্মের ফল
হিসেবে। এসময় থিওফ্রাসটাসএর তত্ত্বটি খুব জনপ্রিয় ছিল। তিনি বলেছিলেন উদ্ভিদের রোগাক্রান্ত
স্থানে কিছু জীবের উদ্ভব হয়। যাদের জন্ম সতস্ফুর্ত। এবং উদ্ভিদের রোগই সেই জীবের জন্মের
কারন।একে বলা হত সতস্ফুর্ত জীবনের তত্ত্ব (Theory of spontaneous generation)। এক হাজার
বছরেরও বেশি সময় ধরে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল।
৩০০ অব্দ থেকে ১৩০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কে
বলা হয় উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের অন্ধকার যুগ। এসময় উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের জ্ঞানে কোন অগ্রগতি
হয়নি।
এন্টোন
ভ্যান ডি ব্যারি

এরপর ১৬৭৬ সালে এন্টোন ভন লিউয়েন হুক
জটিল মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার করেন। আমরা সন্ধান পাই এক অদেখা জগতের। ১৬৮৩ সালে তিনিব্যাকটেরিয়ার
বর্ণনা করেন। ১৭২৯ সালে ইতালিয়ান উদ্ভিদবিজ্ঞানী এন্টোনিও মিকেলি ছত্রাক স্পোরের সন্ধান
পান। তিনি প্রায় ৯০০ টি ছত্রাক প্রজাতির বর্ণনা করেন।১৭৪৩ সালে নিধাম গম দানায় নেমাটোডের
সন্ধান পান। কিন্তু তিনি সেগুলোকে রোগের কারন হিসেবে সনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। ১৭৫৫ সালে
টিলেট স্মাট রোগের বর্ণনা করেন।১৮০৭ সালে প্রিভোস্ট ছত্রাককে স্মাট এর কারন হিসেবে
দায়ী করেন। ১৮৪৫ সালে আয়ারল্যান্ড এ লেট ব্লাইট অফ পটাটো রোগের আক্রমণ হয়। আয়ারল্যান্ড
দূর্ভিক্ষের শিকার হয়। হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। উদ্ভিদের রোগ নিয়ে মানুষ নতুন
করে ভাবতে শুরু করে। এন্টোন ভ্যান ডি ব্যারি উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের ধারণাই পাল্টে দেন।
আলুর লেট ব্লাইট রোগের কারন হিসেবে বিশেষ ধরনের ছত্রাককে (Phytophthora infestens)
শনাক্ত করেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রোগের কারনে জীব না, বরং জীবের কারনেই রোগের সৃষ্টি
হয়। উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের জনক বলা হয় এন্টোন ভ্যান ডি ব্যারি কে।
লুই পাস্তুর প্রমাণ করেন অনুজীবের সৃষ্টি
অনুজীব থেকেই হয়। যা উদ্ভিদে রোগের সৃষ্টি করে। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় রোগের জীবাণু
তত্ত্ব (Germ Theory of disease)১৮৭৬ সালে রবার্ট কচ বর্ণনা করেন কচ পস্টুলেট ।
যা প্যাথোজেন শনাক্তকরণের পথকে উন্মুক্ত করে। এতে উদ্ভিদের রোগ নিয়ে গবেষণায় এক
নতুন দিগন্তেরসূচনা হয়। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী প্যাথোজেন শনাক্ত করতে
শুরু করেন।
রবার্ট
কচ

এবার রোগতত্ত্ববিদদের ভাবতে হয় রোগের
প্রতিকার নিয়ে। ইউনিভার্সিটি অফ বোর্দো এর প্রফেসর মিলার্ড, ডাউনি মিলডিও(পাতার নিচে
পাউডারি আস্তরণ) এরপ্রতিকারের উপায় খুজছিলেন। তিনি দেখতে পান তুতে ও চুনের মিশ্রণ এই
রোগের বিরুদ্ধে দারুন কার্যকরী। এটি ছিল উদ্ভিদ রোগ প্রতিকারের প্রথম রাসায়নিক পদক্ষেপ।
অন্য কোন ছত্রাকনাশক আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত এটি বোর্দো মিক্সার নামে পুরো পৃথিবীতে
বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি বর্তমান সময়েও বোর্দো মিক্সার একটি জনপ্রিয় ছত্রাকনাশক।
পিয়েরে ম্যারি
অ্যালেক্সিস মিলার্ড

এরপর বেইজেরিঙ্ক ভাইরোলজির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা
করেন। এন এ কব নেমাটোড নিয়ে বিস্তর গবেষনা করেন।পল নিরগার্ড তার দুই খন্ডের “সীড প্যাথোলজি
বই প্রকাশ করেন।
এভাবেই ১৯ শতকে জন্ম নেয়া এই নতুন বিজ্ঞানের
৫ টি শাখার সৃষ্টি হয়। মাইকোলোজি, ব্যাকটেরিওলজি, ভাইরোলজি, নোমাটোডলজি ও সীড প্যাথলজি
এই পাচটি শাখায় উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের
উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, সীড প্যাথোলজি সেন্টার, প্লান্ট ডিজিজ ডায়গোনস্টিক ক্লিনিক
উদ্ভিদের রোগ ও রোগের কারননির্ণয়ে গবেষণা করে থাকে। কৃষি সম্প্রসারন বিভাগের প্লান্ট
প্রটেকশন উইং এ ব্যাপারে মানুষকে পরামর্শ ও প্রদান সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে। এখন পর্যন্ত
বাংলাদেশের ফসলে ৮৬০ টি রোগ সনাক্ত হয়েছে। তারমধ্যে ২৫০ টিকে প্রধাণ হিসেবে চিহ্নিত
করা হয়েছে।উদ্ভিদের রোগ যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে ইতিহাস ঘাটলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
১৮৪৫ সালে আয়ারল্যান্ড এ দুর্ভিক্ষ হয় লেট ব্লাইট অফ পটেটো রোগের কারনে।১৯৪৩ সালে ব্লাস্ট
রোগের আক্রমণে বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়। আমাদের প্রয়োজন উদ্ভিদ রোগ নিয়ে বিস্তর গবেষণা।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উদ্ভিদ রোগ প্রতিরোধের বিকল্প নেই।

লেখক
তানভীর আহমেদ নীলয়
ফ্যাকাল্টি অফ এগ্রিকালচার
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

Leave a Reply